সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

বিএনপি সরকারের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা হত্যায় মহিউদ্দিন বাচ্চুর মুক্তি!

প্রকাশিতঃ ৭ জুলাই ২০২৩ | ৮:০০ অপরাহ্ন

আবছার রাফি : আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা দুই নেতাকর্মীকে হত্যার অভিযোগ আছে মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে দুটি হত্যা মামলার আসামিও হন তিনি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস আমিনুল ইসলাম স্বপন হত্যা মামলা থেকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় বাচ্চুর নাম প্রত্যাহার করে বিএনপি সরকার; যার প্রমাণ আদালত থেকে সংগ্রহ করেছে একুশে পত্রিকা। সেই মহিউদ্দিন বাচ্চু চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন!

নিজ দলের কর্মী হত্যায় অভিযুক্ত মহিউদ্দিন বাচ্চুর এমন উত্থানে বিষ্ময়, হতাশা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে প্রকাশ্যে তারা কিছু বলতে চাইছেন না। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম-১০ আসনে পরিচ্ছন্ন ইমেজের প্রার্থীর প্রত্যাশা ছিল সবার। সেটি হয়নি।

সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস আমিনুল ইসলাম স্বপন হত্যার ঘটনায় ১৯৯৯ সালের ২৪ মার্চ নগরের ডবলমুরিং থানায় ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়; ওই মামলায় ৫নং আসামি করা হয় মহিউদ্দিন বাচ্চুকে।

মামলার এজাহার ও নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৯ সালের ২৪ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নগরের টাইগারপাস এলাকার রেলওয়ে ডিএন ২ অফিসে টেন্ডারের শিডিউল জমা দিয়ে বের হওয়ার পথে হামলার শিকার হন আমিনুল ইসলাম স্বপন। তখন আমিনুলকে পেছন থেকে গুলি করেন ১নং আসামি খোকন চন্দ্র তাঁতি। এতে মাটিতে লুটিয়ে কাতরাতে থাকেন আমিনুল। এ সময় আমিনুলের ছোট ভাই সুমন চিৎকার করে বাধা দিতে আসলে ৩নং আসামি কামাল হোসেন ছুরি দিয়ে সুমনের গলায় মারাত্মকভাবে আঘাত করেন।

এই সময় আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসতে চাইলে ৫নং আসামি মহিউদ্দিন বাচ্চু, ৬নং আসামি মো. আলী, ৭নং আসামি নওফেল ও ৮নং আসামি মাসুম ভীতি ছড়ানোর জন্য এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। ৪নং আসামি শহীদুল ইসলাম ও ৫নং আসামি মহিউদ্দিন বাচ্চু উপুড় হয়ে থাকা আমিনুলকে লাথি মেরে উল্টিয়ে দিয়ে আমিনুলের প্যান্টের দুই পকেটে থাকা ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর ২নং আসামি সুভাস কুমার কাটা রাইফেল দিয়ে আমিনুলের পেট বরাবর গুলি করেন। এরপর আশপাশের লোকজন সাহসের সাথে চিৎকার করে এগিয়ে আসতে চাইলে আসামিরা কাটা রাইফেল, বন্দুক ও রিভলবার দিয়ে এলোপাতাড়ি ও শূন্যে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ৩ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আমিনুল।

এই মামলার তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৬, ৩০৭, ৩৭৯ ও ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। পরবর্তীতে আসামি মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩৭৯, ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

এরপর ২০০৩ সালের ১২ মে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা-১ এর উপ-সচিব এস বি আই এম শফিক-উদ-দৌলা স্বাক্ষরিত এক পত্রে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে জানানো হয়, আমিনুল ইসলাম স্বপন হত্যা মামলা থেকে মহিউদ্দিন বাচ্চুর নাম প্রত্যাহার করার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

উক্ত চিঠি পড়ে জানা যায়, ‘রাজনৈতিক কারণে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা’ উল্লেখ করে আমিনুল ইসলাম স্বপন হত্যা মামলার আসামির তালিকা থেকে মহিউদ্দিন বাচ্চুর নাম বাদ দিতে বলা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারা অনুসারে।

‘মামলা পরিচালনা প্রত্যাহারের ফল’ শিরোনামের ধারাটির মূল ভাষ্য হচ্ছে—রায় ঘোষণার আগে, আদালতের অনুমতি নিয়ে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কোনো মামলা সম্পূর্ণ কিংবা তাতে বর্ণিত এক বা একাধিক অপরাধের অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারেন। ওই প্রত্যাহার অভিযোগ বা চার্জ গঠনের আগে অনুমোদিত হলে অভিযুক্তকে ডিসচার্জ করতে হবে। আর চার্জ গঠনের পরে অনুমোদিত হলে বা আইনানুসারে চার্জ গঠনের দরকার না হলে অভিযুক্তকে খালাস দিতে হবে। মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশগুলো মূলত এই ধারাবলে পিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উক্ত চিঠির প্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের ৭ জুন সরকার পক্ষে তৎকালীন মহানগর পিপি আবদুস সাত্তার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ৪র্থ আদালতে মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বিগত সরকার (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিক কারণে হয়রানিমূলকভাবে মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে উক্ত মামলাটি দায়ের করেছে বলে উল্লেখ করা হয় পিপির ওই আবেদনে। একইদিন আবেদন মঞ্জুর করে মহিউদ্দিন বাচ্চুকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত।

রাজনৈতিক বিবেচনায় হত্যা মামলা থেকে বাচ্চুকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন মহানগর পিপি (বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক) অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার স্মরণ নেই। মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ আসলে তা দরখাস্ত করে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠিয়ে দিতাম।’

অন্যদিকে আমিনুল হত্যা মামলা থেকে বাচ্চুকে বাদ দেওয়া হলেও বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার বিচার কাজ চলে। কিন্তু মামলার বাদীসহ ভিকটিম কেউ সাক্ষ্য দিতে আদালতে যাননি বা যেতে পারেননি। ফলে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মামলার বাকি সব আসামিকে খালাস দেন তৎকালীন অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ইনামুল হক ভূঞা। এভাবে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে একজন ছাত্রনেতাকে মেরে ফেলা হলেও কারও বিচার হয়নি।

এদিকে ১৯৯২ সালে নগরীর লালখান বাজারে আওয়ামী লীগের কর্মী তালেব আলী হত্যার ঘটনায়ও মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই মামলা থেকেও বাচ্চু বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে খালাস পেয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এভাবে বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলার তথ্য পেলেও তিনি এসব তথ্য গোপন করেছেন নির্বাচন কমিশনে প্রদান করা হলফনামায়। নিজের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই বা ছিল না বলে হলফনামায় দাবি করেন বাচ্চু।

এছাড়া হলফনামায় মহিউদ্দিন বাচ্চু শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেছেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাউজানের গহিরা এজেওয়াইএমএস বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন বাচ্চু। তবে সেখান থেকে এসএসসি পাস করেছেন এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা দাবি করেছেন, মহিউদ্দিন বাচ্চু এসএসসি পাস করেননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯১ এবং ২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখন মহিউদ্দিন বাচ্চু তেমন সক্রিয় ছিলেন না। তবে দল ক্ষমতায় আসার পর তিনি বেশ সক্রিয় হন। মহিউদ্দিন বাচ্চু নগর ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। সেখান থেকে পরবর্তীতে নগর যুবলীগের প্রথমে যুগ্ম সম্পাদক এবং পরবর্তীতে আহ্বায়ক হন।

একসময় সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন বাচ্চু। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি রাউজান। মহিউদ্দিন বাচ্চুর গ্রামের বাড়িও রাউজান। সম্পর্কে মামা-ভাগিনা এমন পরিচয় চাউর হবার পর বাচ্চুকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মহিউদ্দিন চৌধুরী টানা ১৭ বছর চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন। ওই সময় চট্টগ্রামের বিলবোর্ড ব্যবসা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছেন বাচ্চু।

২০১০ সালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হন মনজুর আলমের কাছে। তবে তাতেও বাচ্চুর বিলবোর্ড ব্যবসায় কোনো টান পড়েনি। বরং বিএনপির সমর্থন নিয়ে মেয়র হওয়া মনজুর আলমের সময়ে বাচ্চু এই ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করেন। তার অ্যাডভেলি নামের বিলবোর্ড প্রতিষ্ঠানের নামে নগরীর কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সড়কের অংশগুলো ভাগ করে বরাদ্দ দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। ২০১৫ সালে আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র হলে নগরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং নগরীর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে পুরো শহর থেকে বিলবোর্ড উচ্ছেদ করেন। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাচ্চুর বিলবোর্ড ব্যবসা অব্যাহত আছে।

জানা গেছে, বিলবোর্ড ব্যবসার পাশাপাশি জমি কেনাবেচার ব্যবসায়ও বিশাল বিনিয়োগ আছে বাচ্চুর, যা হলফনামায় উল্লেখ নেই। নির্বাচন কমিশনে তিনি মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন ৬ কোটি টাকা। আবার বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে তার ২ কোটি ৮২ লাখ ২২ হাজার ৬০৬ টাকা ঋণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও বাচ্চুর রাজনৈতিক একাধিক সহকর্মী দাবি করেছেন, নির্বাচন কমিশনে সম্পদের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি সম্পদ আছে মহিউদ্দিন বাচ্চুর।

বিএনপি সরকারের নির্দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘৯৯ সালের কথা, এখন কিছু মনে নেই। আমি এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত।’ এ কথা বলেই কল কেটে দেন বাচ্চু।