চট্টগ্রাম : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর একবছর। সব ঠিকঠাক থাকলে ২০১৮ এর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে বহু প্রত্যাশিত এই নির্বাচন। দলের নিবন্ধন রক্ষা এবং রাজনীতিতে নিজেদের শক্তিমত্তা টিকিয়ে রাখতে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা অনেকটা নিশ্চিত।
বিএনপিসহ ছোটবড় সবদলের অংশগ্রহণে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন হবে তা এখন থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে। বড় দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র নির্বাচনমুখী নানা তৎপরতা ও এই দুই দলের নেতাদের মনোনয়ন-দৌড় সেই কথাই জানান দিচ্ছে।
সারাদেশের মতো মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতাকর্মীরাও। চট্টগ্রাম মহানগরীর চার আসনে কারা আছেন মনোনয়ন দৌড়ে, হাইকমান্ডের আশীর্বাদপুষ্ট কারা তা-ই মূলত আলোচনা করা হয়েছে একুশে পত্রিকার নির্বাচনী কড়চার এই পর্বে।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ আংশিক) : এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর এক অংশের সভাপতি মাঈন উদ্দিন খান বাদল। মহাজোটের হয়ে নবম ও দশম জাতীয় সংসদে নৌকা প্রতীক নিয়ে পরপর দুইবার এমপি হওয়ার স্বাদ পেয়েছেন তিনি। মহাজোটের শরীকদল জাসদ এখন বিভাজিত ও দ্বিখণ্ডিত রাজনৈতিক দল।
কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি- আজীবন এমন ‘তকমা’ গায়ে লেপ্টে থাকা এই রাজনৈতিক দল গেল বছর হাসানুল হক ইনু ও মাঈন উদ্দিন খান বাদল-এই দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারা দুইজন এখন দুই অংশের নেতা।
খণ্ডিত অংশের জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক দলকে মোর্চায় ভিড়িয়ে কতটুকু লাভবান হওয়া যাবে সেই কথা এবার বেশ ভাবছে মহাজোটের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ। সেই হিসাব-নিকাশে এবার বাদ পড়তে পারেন মাঈন উদ্দিন খান বাদল। আর তাই যদি হয় মনোনয়ন দৌড়ে অবশিষ্ট থাকবেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক এম রেজাউল করিম চৌধুরী ও কোষাধ্যক্ষ সিডিএ চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম। আব্দুচ ছালাম ২০০৮ সালের ৯ম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মহাজোটের স্বার্থ বিবেচনায় এই আসনে মনোনয়নবঞ্চিত হলে পরবর্তীতে তাকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করে সরকার।
২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে অদ্যাবধি তিনি সিডিএ’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়ের মধ্যে তার দায়িত্বের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৬ বার। ছালামের সর্বশেষ মেয়াদ শেষে একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা আওয়ামী পরিবারের ত্যাগী ও পরীক্ষিত মানুষ রেজাউল করিম চৌধুরীকে সিডিএ’র নতুন চেয়ারম্যান করার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে আগাম অভিনন্দনও পেয়েছেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। আবারও দুই বছরের জন্য চেয়ারম্যান নিয়োগ পান আব্দুচ ছালাম। সিডিএ’র ব্যানারে চট্টগ্রামে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে সিডিএ’র চেয়ারম্যান হিসেবে আব্দুচ ছালামকেই বরাবর উপযুক্ত মনে করছে আওয়ামী লীগ সরকার।
সূত্র মতে, সিডিএ’র চেয়ারম্যান পদ হাতছাড়া করা রেজাউল করিমকে ভবিষ্যতে বড় পরিসরে মূল্যায়ন করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয় উপরের মহল থেকে। সেই হিসেবে আশা করা হচ্ছে রেজাউল করিম চৌধুরীই জীবনের পড়ন্তবেলায় মূল্যায়িত হতে পারেন আসন্ন সংসদ নির্বাচনে। এজন্য ইতোমধ্যেই তার পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে। মনোনয়নের দাবি জানিয়ে তার ছবি সম্বলিত পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে এই সংসদীয় এলাকা।
এই অঞ্চলের রাজনীতি সচেতনদের মতে, ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের হাতে রাজনীতি বন্দী হওয়ার অস্থির এই সময়ে রেজাউল করিমের মতো ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদদের মূল্যায়ন করে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে ‘রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায়’ থাকতে দেওয়া উচিত।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। দলীয় হাইকমান্ড বয়স্ক, অসুস্থ নেতাদের মনোনয়ন দেয়া থেকে ‘বিরত থাকার নীতি’ অনুসরণ করলে সে ক্ষেত্রে এই আসনে মনোনয়ন পেতে পারেন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি আবু সুফিয়ান।
আবু সুফিয়ান যখন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি তখন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির বর্তমান সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন ছাত্রদল মহানগরের ক্ষুদ্র ইউনিট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে সভাপতি ও ডা. শাহাদাত হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫ বছর আগে ঘোষিত চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটিতে আবু সুফিয়ানকে সিনিয়র সহ সভাপতি করা হয়। তৃণমূলের সঙ্গে সংযোগ, ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় আবু সুফিয়ানকে আমীর খসরুর কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করলে একটি শক্তিশালী, মেসিউরড ও ব্যালেন্স কমিটি হতে পারতো বলে ব্যাপক আওয়াজ উঠে সেসময়।
পরবর্তীতে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী তারুণ্যনির্ভর নতুন কমিটি গঠনের প্রশ্নে আবু সুফিয়ান দলের মহানগর কমিটির সভাপতি আর ডা. শাহাদাত হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করা হবে বলে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল চট্টগ্রাম নগর বিএনপি শিবিরে। পরবর্তীতে দেখা গেলো নতুন কমিটিতে ডা. শাহাদাত হোসেনই সভাপতি, আর সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রাম নগর যুবদলের প্রাক্তন সভাপতি আবুল হাশেম বক্কর। এই কমিটিতেও বরাবর সিনিয়র সহ সভাপতি আবু সুফিয়ান।
জানা গেছে, ডা. শাহাদাত হোসেনের কমিটিতে আবু সুফিয়ানকে সাধারণ সম্পাদক করার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র শাহাদাতের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাবটি একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরিয়ে দেন আবু সুফিয়ান। রাজনীতি সচেতনদের মতে, বারবার বঞ্চনার শিকার আবু সুফিয়ানকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে তার ত্যাগ ও ধৈর্যের মূল্যায়ন করতে পারে হাইকমান্ড।
এই আসনে ৯ম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা এরশাদ উল্লাহও মনোনয়ন চাইতে পারেন। কিন্তু দল থেকে বহিস্কারের খড়গ এখনো ঝুলছে তার মাথায়। সেই বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে সেই আশা সুদুর পরাহত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাছাড়া বহিস্কার হওয়ার পর সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এরশাদ উল্লাহ।
চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) : আসনটির বর্তমান এমপি জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের হিসাব এবং জাতীয়পার্টির সাথে সমঝোতা, সমীকরণ বিবেচনায় এই আসনটি বাবলুকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোটে না থাকার ঘোষণা দিয়ে নামসর্বস্ব কিছু দল নিয়ে ৫৮ দলীয় জোট গঠন করেন জাপা চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দরকষাকষি ও আরও বেশি করে মূল্যায়িত হওয়ার জন্য এটি এরশাদের নতুন বাহাস ও নাটকেরই অংশ। চূড়ান্তভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জোটবদ্ধ নির্বাচনে যাবে এরশাদের জাতীয় পার্টি। আর তাই যদি হয় জিয়াউদ্দিন বাবলুকেই ফের আসনটি ছেড়ে দেবে আওয়ামী লীগ।
যদি জোটবদ্ধ নির্বাচন না হয় সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নতুন প্রার্থী বাছাই করবে। যোগ্যপ্রার্থী বাছাইয়ে সরকারি দুটি গোয়েন্দা সংস্থা ও দলীয়ভাবে জরিপ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন করে অল্প ভোটে বিএনপির নবাগত শামসুল আলমকে পরাজিত করে প্রথমবার এমপি হন নুরুল ইসলাম বি.এসসি। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলুকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে সরকার গঠনের দেড় বছরের মাথায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয় নুরুল ইসলাম বি.এসসিকে।
জীবনে একটিবারের জন্য এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখা বি.এসসি এমপিই শুধু হননি, প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় বিশাল মন্ত্রীত্বের স্বাদ পান। গত আড়াই বছরের মন্ত্রীত্বকালে নজরকাড়া কোনো কাজ করে দেখাতে পারেননি জনাব বি.এসসি। তার কাছে এ যেন শ্রেফ একটি চাকরি-অফিস ডিউটি। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী থেকেও যেন নেই। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া এই নেতার সাথে নির্বাচনী এলাকা তথা চট্টগ্রামের মানুষের তেমন কোনো যোগাযোগও নেই। নেই উল্লেখযোগ্য কোনো অনুষ্ঠান, কর্মসূচি। মাঝে মাঝে চট্টগ্রামবাসীও টের পান না চট্টগ্রাম থেকে একজন মন্ত্রী আছেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রণালয়ে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছে সরকার তথা আওয়ামী লীগ দলীয় হাইকমান্ড। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শম্বুক গতিতে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসন্তোষ প্রকাশ করে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের ফাইল তলব করার তথ্যও জানিয়েছে ওই সূত্রটি।
এই অবস্থা আঁচ করতে পেরে নুরুল ইসলাম বি.এসসি নানাভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তারই অংশ হিসেবে গত তিনমাস আগে বিদেশ সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তার পছন্দের খাবার রান্না করে গণভবনে পাঠিয়ে দেন বি.এসসি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বি.এসসির পাঠানো খাবার খাননি। গণভবনের কর্মচারিরা খেয়েছেন অতি যত্নে রান্না করা সেই খাবার।
ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসা নুরুল ইসলাম বি.এসসিকে নতুন করে দলের কাজে লাগানো এবং মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবছে না দলীয় হাইকমান্ড- একথা অনেকটা নিশ্চিত। বিষয়টি বুঝতে পেরে বি.এসসি তার জ্যেষ্ঠ সন্তান মুজিবুর রহমানকে তার আসন অথবা বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনে সেট করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু সে চেষ্টাও দলের কাছে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না।
এই আসনে আলোচনায় আছেন চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শোতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে অংশ নিয়ে এরইমধ্যে তিনি রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। গেল ঈদের পর বাকলিয়ার তিনটি ওয়ার্ডে সর্বস্তরের মানুষের সাথে ব্যতিক্রমী মতবিনিময় সভা করার পর অনেকে ধরে নিয়েছেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি এগোচ্ছেন।
তবে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী মহল বলছে, নওফেলদের মতো দলের তরুণ নেতাদের নির্বাচন নামক পরীক্ষায় ঠেলে দেওয়ার চেয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণদের পাস করিয়ে আনার গুরু দায়িত্ব আসতে পারে। দলের মনোনীত প্রার্থীদের জেতানোর জন্য গঠনমূলক প্রচার-প্রচারণায় এসব তরুণ ও মেধাবী নেতাদের মাঠে নামাতে হাইকমান্ড বেশি আগ্রহী বলে জানা গেছে।
তবে প্রেস্টিজিয়াস খ্যাত এই আসনের তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এমন ডায়নামানিক মেধাবী নেতাকেই মনোনয়নের জন্য বেছে নিতে চায় আওয়ামী লীগ। আর সেক্ষেত্রে দলের কেন্দ্রীয় উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলামের বিষয়টিও আসছে আলোচনায়। সাতকানিয়ার সন্তান হলেও আমিনুল ইসলামের বেড়ে উঠা, ছাত্ররাজনীতির শুরুর দিকটা এই সংসদীয় আসনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম। দুঃসময়ে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার কাজটিও তিনি করেছেন কৈশোর ও তরুণ বয়সে নগরীর আন্দরকিল্লাস্থ ঘাটফরহাদবেগে দীর্ঘসময় বসবাসকালে।
গেল ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে দলীয় মনোনয়নের প্রাথমিক চিঠি হাতে পেয়েও হাইকমান্ডের অনুরোধে আমিনুল ইসলাম সেই মনোনয়ন ফিরিয়ে দেন জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীকে। সেই গেড়ে বসা নদভী এবারও তার অদৃশ্য শক্তির জোরে সাতকানিয়া থেকে মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে পারেন। সেই হিসেবে সাতকানিয়ার মনোনয়ন প্রত্যাশী আমিনুল ইসলামকে চট্টগ্রাম কোতোয়ালী আসনে সেট করা যায় কিনা তাও ভাবনায় রেখেছে আওয়ামী লীগ।
এই আসনে সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী প্রয়াত এম এ মান্নানের জ্যেষ্ঠ সন্তান সাহিত্যানুরাগী আবদুল লতিফ টিপুকেও নিয়ে হচ্ছে হাইকমান্ডে আলোচনা। বর্ষীয়ান জননেতা এম এ মান্নানের যোগ্য উত্তরাধিকার আবদুল লতিফ টিপু ১৯৭৭ সালে বাগমনিরাম ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সদস্য থেকে পরবর্তীতে বাগমনিরাম ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি, মহানগর যুবলীগের সদস্য, বাগমনিরাম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক, কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদকের পর এখন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সদস্য। সজ্জন, নিষ্কলুস রাজনীতিবিদের সন্তান- এই পরিচয় ছাড়াও আবদুল লতিফ টিপু এ পর্যায়ে উঠে এসেছেন একেবারে তৃণমূল থেকে। প্রয়াত বাবার তৈরি মাঠ এবং ভাবমূর্তির বাইরেও টিপুর আছে নিজস্ব স্বকীয়তা, তৃণমূলে যোগাযোগ।
একসময়ের তুখোর ছাত্রনেতা, আলকরণ ওয়ার্ডের বর্তমান কমিশনার তারেক সোলায়মান সেলিমও আছেন মনোনয়ন আলোচনায়। বর্তমান পেশীশক্তি ও অর্থনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতির যুগেও তারেক সোলায়মান সেলিম ধরে রেখেছেন পরিচ্ছন্ন, নান্দনিক রাজনীতির তকমা। দলমত নির্বিশেষে বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে চারবার কমিশনার নির্বাচিত হয়েছেন তারেক সোলায়মান।
এছাড়া চট্টগ্রাম কোতোয়ালী আসনে পেশাজীবী নেতা, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরীও আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন।
কোতোয়ালী আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে আছেন নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী শিল্পপতি শামসুল আলম।
এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আশীর্বাদ ছাড়াও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ডা. শাহাদাতের রয়েছে সুসম্পর্ক। ৫ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বিএনপির রাজনীতিতে একের পর এক চমক দেখিয়েছেন তিনি। বিএনপির শীর্ষ পদে আসাটাও ছিল তার বড় চমক। একইভাবে বিএনপির মনোননয়ন নিয়ে চট্টগ্রামবাসীকে আবারও চমকে দিতে চান ডা. শাহাদাত। এজন্য বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রায় সব নেতাকে ‘কাছের’ করে নিয়েছেন তিনি।
গেলবারের প্রার্থী শামসুল আলম শুরুতেই আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। ব্যর্থ হয়ে রাতারাতিই নিয়ে আসেন বিএনপির মনোনয়ন। সেসময় তার অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য ছিল তুঙ্গে। কিন্তু পরবর্তীতে অর্থ ছিটিয়ে, নেতাদের খুশি রেখে বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে অর্থহারা যেমন হয়েছেন তেমনি লাঠে উঠে তার পরিচালনাধীন এমএবি গ্রুপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঋণের ভারে জর্জরিত শামসুকে চেক ডিজঅনারের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানার মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে হাতছাড়া হয়েছে নগর বিএনপির সহ সভাপতির পদ, দলীয় অবস্থান। নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রীয় বিএনপি আর চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সদস্য পদ আকড়ে থাকলেও সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক সব মিলিয়ে এখন দুর্বল মানুষের বড় প্রতিচ্ছবি শামসুল আলম। বাংলাদেশের মনোনয়ন প্রাপ্তির যে সংস্কৃতি তাতে রাজনীতির বাইরের অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থহীন মানুষের কদর নেই। তাই শামসুল আলমের মনোনয়ন চাওয়ার ইচ্ছাটি শেষপর্যন্ত ইচ্ছাতে থেকে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-আগ্রাবাদ) : এই আসনের বর্তমান এমপি প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আফছারুল আমীন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচন করে প্রথম জয়ের স্বাদ পান আফছারুল আমীন। মহাজোটভুক্ত হলেও এই আসনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি যথাক্রমে নৌকা ও লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে পৃথক নির্বাচনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
অপরদিকে সঙ্গীহীন জাতীয়পার্টির বাইরে ডা. আফছারুল আমীনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে আসেন বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী তিন তিনবারের মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত নির্বাচনপূর্ব প্রার্থী পরিচিতি সমাবেশে এক এক করে হাত উচিয়ে সব প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। কিন্তু মহাজোটের ঐক্যে ফাটল দেখা দিতে পারে সেই আশঙ্কায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী, মঞ্চে উপবিষ্ট ডা. আফছারুল আমীনকে পরিচয় করিয়ে দেননি তিনি।
নির্বাচনের মাত্র দুদিন আগে মহাজোটভুক্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থী চেম্বার সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের সাথে দেখা করে নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ফটোসেশনের ছবি ছাপা হয় পত্রিকান্তরে। মহিউদ্দিন চৌধুরী আফছারুল নয়, আছেন মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের সাথে-এই ছবির মধ্যদিয়ে সেই ইঙ্গিতও খুঁজে পায় নগরবাসী।
নির্বাচনের মাঠে এমন বৈরি ও প্রতিকূল অবস্থায় আফছারুল আমীন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনার হাত তুলেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। জীবনে একবার এমপি হওয়ার ইচ্ছাটাই ছিল সেই প্রার্থনার মূল সুর। বিধাতা শুনেছেন সেই প্রার্থনা। বিএনপি, জাতীয়পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুর আলমদের (পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র) মতো প্রার্থীদের হারিয়ে অল্প ভোটের ব্যবধানে স্বপ্নের এমপি হয়ে যান আফছারুল আমীন। এরপর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন চট্টগ্রামবাসীকে।
পরবর্তীতে মন্ত্রীসভার রদবদল হলে দায়িত্ব পান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এমপি হন ডা. আফছারুল। মন্ত্রীত্ব না পেলেও তাকে দেয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ। এতবড় একটি পদে থেকেও দৃশ্যত কোনো কর্মকা-, আলোচনা নেই আফছারুল আমীনের। ক্রমান্বয়ে নির্বাচনী এলাকার মানুষের সাথেও বিচ্ছিন্ন, যোগাযোগহীন হয়ে পড়েন। আফছারুল আমীনের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের এই অভিযোগ সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র হয়ে উঠেছে।
এই অভিযোগ তুলে আফছারুল আমীন আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না বলে রব উঠলেও তার স্বচ্ছ ও ক্লিন ইমেজ নিয়ে কিন্তু কারো প্রশ্ন নেই। ৯ বছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার পরও তার বিরুদ্ধে বড়ধরনের কোনো বদনাম নেই। নেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ।
এই আসনে আলোচনা আছে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা প্রাক্তন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম মনজুর আলমকে নিয়ে। আওয়ামী লীগের সমর্থনে তিনবার ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদান্যতায় দুই বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন মনজুর আলম। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল অর্থ ছিটানোর পরও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ডবলমুরিং আসনে ৬ হাজারের মতো ভোট পান মনজুর আলম।
দেড় বছরের মাথায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই মনজুর আলমই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে হাজির হন। সিটি মেয়রও হয়ে যান নানা সমীকরণে। এরপর বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। দ্বিতীয়বার বিএনপির সমর্থনে মেয়র নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যাওয়ার পর বিএনপির সঙ্গে ঘোষণা দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিছুদিন নীরব থাকার পর পুরোনো রাজনৈতিক গুরু মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলেন। নিজ উদ্যোগে পালন করা শুরু করেন জাতীয় শোক দিবসসহ নানা কর্মসূচি। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তার এসব কর্মসূচি পালনের চেষ্টা বলে মনে করেন অনেকে।
এদিকে, এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগ নেত্রী, প্রাক্তন ওয়ার্ড কমিশনার ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের শিক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানুর নামও শোনা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১২ নং সরাইপাড়া, ২৩ নং উত্তর পাঠানটুলি ও ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড মিলে গঠিত সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৯ থেকে (২০০০ থেকে ২০১৫) পরপর তিনবার সর্বোচ্চ ভোটে কমিশনার নির্বাচিত হন রেহানা বেগম রানু।
চটগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১ টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার (প্রায় দেড় লাখ) এই সংরক্ষিত ওয়ার্ডে। তিনটি নির্বাচনে এই ভোটাররাই রানুকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন, পাঠিয়েছেন মিনি পার্লামেন্ট খ্যাত সিটি করপোরেশনে। বলাবাহুল্য, ডবলমুরিং আসনের এই বিপুল সংখ্যক ভোটারের সঙ্গে অ্যাডভোকেট রানুর রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ।
সূত্র মতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রশ্নে গতবারের তুলনায় এবার আরও অধিক সংখ্যক নারী নেত্রীকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি মনোনয়ন দিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে অন্তত একজন নারীকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। সার্বিক বিচারে সেই নারীটি হতে পারেন এক-এগারোর সময় সমস্ত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া (জননেত্রীর মুক্তির দাবিতে ৫ শতাধিক নারীকর্মী নিয়ে চটগ্রাম প্রেসক্লাব চত্ত্বরে সমাবেশ করে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন) রেহানা বেগম রানুই।
জানা গেছে, সেই ভাবনা সামনে রেখেই সদ্য ঘোষিত যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র রানুকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
’৯০ এর গণ আন্দোলনের তুখোড় সাংস্কৃতিক কর্মী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু ইতোপূর্বে ডবলমুরিং আসন থেকে দুবার (২০০৮ ও ২০১৩) সরাসরি এবং তিনবার সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ২০০৮ এ প্রথম মনোনয়ন চেয়ে তৃণমূলের ভোটে তৃতীয় হন তিনি।
এছাড়া নগরীর এই আসন থেকে সৎ, ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ নেতা হিসেবে সমধিক পরিচিত যুবলীগের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম মেম্বার সৈয়দ মাহমুদুল হকের নামও আছে আলোচনায়। পারিবারিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সৈয়দ মাহমুদুল হকের।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রয়াত এম এ আজিজের সন্তান চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সদস্য সাইফুদ্দিন খালেদ বাহারও এই আসনে মনোনয়ন-প্রত্যাশী। ডবলমুরিং আসনে নির্বাচন করার ব্যাপারে নেত্রীর গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন দাবি করে এই সংসদীয় আসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন সাইফুদ্দিন খালেদ বাহার।
পাশাপাশি এই আসনে মনোনয়ন লাভে আগ্রহী নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু, যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ। রাজনীতির বাইরেও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ফরিদ মাহমুদের নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের পোস্টারে ছেয়ে গেছে নগরীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত।
বিএনপি থেকে এই আসনে মনোনয়ন অনেকটা নিশ্চিত গতবারের প্রার্থী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের। কাজেই অন্য কোনো মনোনয়ন প্রত্যাশীর নাম শোনা যাচ্ছে না এখানে।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) : এই আসনের বর্তমান এমপি চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি এম এ লতিফ। নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত এম এ লতিফ বিএনপির মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়ে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে আসেন (২৪ ঘণ্টায় মনোনয়ন, ১৩ দিনে এমপি-বিভিন্ন সময় একাধিক অনুষ্ঠানে দেয়া লতিফের বক্তব্য)। নৌকা প্রতীকের জোয়ারে এমপি হন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে হারিয়ে।
দশম সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের টিকেটে এমপি হন। দুই মেয়াদের এমপি থাকাকালে নানা বিতর্কের জন্ম দেন ‘অঘটন ঘটন পটিয়সী’ এম এ লতিফ। বঙ্গবন্ধুর ছবির সাথে নিজের শরীরের অংশ জোড়া লাগিয়ে ব্যানার টাঙ্গিয়ে দেশজুড়ে বিতর্কিত হন লতিফ। তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতি ও অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উন্মাতাল হয়ে উঠে চট্টগ্রাম। এসময় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগেরও দাবি উঠে সব মহলে। এসব কারণে আগামী নির্বাচনে এম এ লতিফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্যকথা। গত ৯ বছরে সংসদ সদস্য পদ ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে ব্যবসার নতুন নতুন পথ খুলেছেন লতিফ। অস্ট্রেলিয়ায় এককভাবে গড়ে তুলেছেন বিশাল ডেইরি ফার্ম। কাজেই আগের তুলনায় তিনি অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। অর্থনৈতিক শক্তির মাপকাঠি যদি এ আসনে মনোনয়নপ্রাপ্তির যোগ্যতা হয়ে থাকে তাহলে যে যত কথাই বলুন না কেন ফের এম এ লতিফই পাবেন এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন।
সেক্ষেত্রে মনোনয়ন দৌড়ে থাকা আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ হিসেবে পরিচিত খোরশেদ আলম সুজন আবারও উপেক্ষিত হতে পারেন। জাতীয় ছাত্রলীগের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনের তৃণমূল সম্পর্ক, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি- এই পদ ও অভিধাগুলো এম এ লতিফের অর্থ ও অদৃশ্য শক্তির কাছে আবারও পরাজিত হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
এ আসনে আরেকজন যোগ্য মনোয়ন দাবিদার যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন প্রেসিডিয়াম মেম্বার, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের যখন সভাপতি, আজকের সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন তখন সেই কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তার সমসাময়িক কিংবা জুনিয়র অনেকেই সরকারি ক্ষমতা ও দলের নানা সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও তিনি ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বরং নিজের পকেটের টাকা ও শ্রম দিয়ে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়তে অকাতরে কাজ করেছেন।
এদিকে, নানা কারণে হাইকমান্ডের কাছে এম এ লতিফের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে উঠেছে, মনোনয়ন ফসকে যেতে পারে- এ কথা মাথায় রেখে নীরবে বন্দর-পতেঙ্গা আসন থেকে ব্যবসায়িক কোটায় নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছেন রাউজানের সন্তান চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। তারই অংশ হিসেবে নিজের প্রার্থী হওয়ার গোপন ইচ্ছার কথা মাঠপর্যায়ে জরিপের কাজে নিয়োজিত সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রকাশ করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলেও সেই আগ্রহের কথা তুলে ধরেছেন মাহবুবুল আলম। এ খবরে বন্দর-পতেঙ্গা এলাকার তরুণদের একটি বড় অংশ ‘বহিরাগত ঠেকাও’ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই আসনে বিএনপির একক, অপ্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। নিজের মনোনয়নের পাশাপাশি অন্যজনের মনোনয়নপ্রাপ্তিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম বিএনপির এই নেতা ২৬ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে বিএনপির প্রভাবশালী ৪-৫ জনের একজনে পরিণত হয়েছেন।
আমীর খসরুর ঘনিষ্ঠ সূত্র মতে, সাবেক মন্ত্রী মাহমুদুন্নবী চৌধুরীর সন্তান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিতা মাহমুদুন্নবী চান তার কোনো উত্তরসুরী রাজনীতি করুক। পিতার এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন জ্যেষ্ঠ সন্তান চেম্বার সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। তখনই প্রস্তাবটি লুফে নেন দ্বিতীয় সন্তান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বিলেতফেরৎ, উচ্চ শিক্ষিত আমীর খসরু তখনও বাংলায় ভালো কথা বলতে পারেন না।
সেই যাই হোক, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নের জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। স্মার্ট, শিক্ষিত, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল আমীর খসরুর মনোনয়ন একপ্রকার নিশ্চিতও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তার বাবা মুক্তিযুদ্ধকালীন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এই অভিযোগে হাতছাড়া হয়ে যায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। এরপর আমীর খসরু ছুটে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে। কিন্তু এই আসনে খালেদা জিয়া নিজেই নির্বাচন করবেন। চেয়ারপারসন প্রস্তাব দিলেন তাঁর নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব গ্রহণের। সফলভাবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারলে রাজনীতিতে দুয়ার খুলে যাবে তা বুঝতে সময় লাগেনি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন চেয়াপারসনের প্রস্তাব। সমস্ত খরচ জুগিয়ে সফল ও পরিকল্পিত নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে বিপুল ভোটে জয়ী করে আনেন বেগম খালেদা জিয়াকে।
দুমাস পর খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া আসনে উপ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা এম এ মান্নানকে পরাজিত করে প্রথমবারেই এমপি হয়ে যান খসরু। এরপর ৯৬, ২০০১ সালেও এমপি হন তিনি। ২০০১ এর নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে বাণিজ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী করা হয়।
কিন্তু মাঝপথে আবার মন্ত্রীত্ব হারান তিনি। এসময় দল ও সরকারে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়েছে মনে করা হলেও পরবর্তীতে ক্রমশ দলের অভ্যন্তরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন তিনি। চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি ছাড়াও একই সময়ে পালন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। আওয়ামী লীগ থেকে আগত বিএনপি প্রার্থী মনজুর আলমকে মেয়র বানাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। গেল বছর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। পক্ষান্তরে কাছে এসেও স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ থেকে ছিটকে পড়েন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, একসময়ের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমান।
এ থেকে বোঝা যায়, রাজনীতিতে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর অবস্থান কত উপরে! বিএনপি রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ও পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীই বন্দর-পতেঙ্গা আসনে বিএনপির আগামীর প্রার্থী সেকথা পুরোপুরি নিশ্চিত।