সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

পছন্দের দুই প্রার্থীকে ভোট দিতে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের শপথ করালেন এমপি নদভী!

প্রকাশিতঃ ১৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০১ অপরাহ্ন


চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী প্রকাশ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য তিনি গতকাল শুক্রবার রাতে তার গ্রামের বাড়িতে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন এবং তাদের জন্য নৈশভোজের আয়োজন করেছেন।

সেখানে উপস্থিত সকল চেয়ারম্যান-মেম্বারকে জেলা পরিষদ নির্বাচনে তালা প্রতীকের মেম্বার প্রার্থী মনির আহমদ ও সংরক্ষিত ৫ নং ওয়ার্ডের প্রার্থী সুরাইয়া খানমকে (ফুটবল) ভোট দিতে অনুরোধের পাশাপাশি শপথ করানোর অভিযোগ উঠেছে এমপি নদভীর বিরুদ্ধে।

মেম্বার প্রার্থী মনির আহমদ কেঁওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। অপর মেম্বার প্রার্থী সুরাইয়া খানম লোহাগাড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি রিদুওয়ানুল হক সুজনের স্ত্রী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগামি সোমবার (১৭ অক্টোবর) অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে উক্ত দুজন ছাড়াও মেম্বার পদে প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর ভগ্নিপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম ফেরদৌস রুবেল (হাতি), দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আবদুল আলিম (বৈদ্যুতিক পাখা) এবং সংরক্ষিত আসনে অপর প্রার্থী দক্ষিণ জেলা মহিলা লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি শাহিদা আকতার জাহান (হরিণ)। এর মধ্যে গোলাম ফেরদৌস রুবেল ও শাহিদা আকতার জাহানের অবস্থা অন্যদের চেয়ে ভালো ও স্থানীয় জনমতও তাদের পক্ষে বলে জানা গেছে।

এ পরিস্থিতিতে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে এমপি নদভীর প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া ও শপথ করানোর বিষয়টিতে স্থানীয়ভাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সচেতনজনরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে যারা প্রার্থী হয়েছেন সবাই আওয়ামী পরিবারের। যোগ্যতা বিবেচনায় ভোটাররা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করবেন। কিন্তু এমপি নদভী ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে শুধু ক্ষোভ-অসন্তোষই তৈরি করেননি, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।

অথচ দুদিন আগে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী। বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছেন অনেকেই। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেবও প্রভাবমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এমপি নদভী ভোটের পরিবেশ নষ্ট করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন– এমন অভিযোগ প্রার্থীদের।

মেম্বার প্রার্থী গোলাম ফেরদৌস রুবেল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নদভী সাহেব মতবিনিময় সভায় আমাকে দাওয়াত দেননি। শেষের দিকে আমি নিজ থেকেই চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গে দেখা হবে সেই আশায় গিয়েছিলাম। তাদের কাছেই শুনি এমপি নদভী সাহেব তার পছন্দের দুই প্রার্থীকে ভোট দিতে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের হাত উঁচিয়ে শপথ করানোর কথা। তার পছন্দের দুই প্রার্থীকে জেতাতে না পারলে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের এলাকায় উন্নয়ন-বরাদ্দ বন্ধ করে দেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন এমপি নদভী।’ বলেন গোলাম ফেরদৌস রুবেল।

এমপি নদভীর এমন কাণ্ডে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন জানিয়ে মেম্বার প্রার্থী শাহিদা আকতার জাহান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এমপি সাহেব যেটা করেছেন সেটা দুঃখজনক। তার প্রার্থী মনির আহমেদ, আর ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার প্রার্থী সুরাইয়া খানম। তাদের জেতাতে এমপি নদভী সাহেব যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন শুধু নয়, মারাত্নক অন্যায়। লোকমুখে শুনে আমি সেখানে হাজির হয়ে দেখতে পাই আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হচ্ছে। আমি এসবের জবাব দিতে চাইলে এমপি আমাকে থামিয়ে দেন। তিনি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বলেছেন, তাদের দুই প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা না হলে তিনি উন্নয়ন-বরাদ্দ বন্ধ করে দেবেন। এসব ঘটনা দেখে আমি সেখানে অসুস্থ হয়ে যাই। আমার প্রেশার একেবারে নিচে নেমে যায়। এক পর্যায়ে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করি। দক্ষিণ জেলা মহিলা লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আমাকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়বিহীন একজন মহিলাকে জেতাতে তারা যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তা লজ্জা ও দুঃখজনক। আমি মাঠে আছি, মাঠে থাকব।’

বৈদ্যুতিক পাখা প্রতীকে মেম্বার প্রার্থী আবদুল আলীম বলেন, ‘নদভী সাহেব দুই প্রার্থীর সমর্থনে ভোটারদের (চেয়ারম্যান-মেম্বার) সঙ্গে মতবিনিময় ও তাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। সেখানে আমার কোনো আমন্ত্রণ ছিল না। তবুও মেম্বার-চেয়ারম্যান এসেছেন শুনে শেষের দিকে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। চলে যাওয়ার সময় কয়েকজনের সঙ্গে আমার কুশল বিনিময় হয়েছে। এমপি সাহেবের সঙ্গেও চোখাচোখি হয়েছে, কিন্তু কথা হয়নি।’

আলীম বলেন, ‘আমি প্রত্যেকটা ভোটারের কাছে গিয়েছি। গত কদিন অনেক কষ্ট করেছি। আমরা সকল প্রার্থী আওয়ামী ঘরানার। কিন্তু এমপি সাহেব শুধু দুজনের জন্য এভাবে প্রকাশ্য হওয়া, তাদেরকে ভোট দিতে শপথ করানো ঠিক হয়নি। তাতে আমরা কষ্ট পেয়েছি।’

অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম-১৫ আসনের (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মাদক-সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী সুধী সমাবেশে যোগ দিতে ১০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাতকানিয়া আসবেন। তার আগমন উপলক্ষে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার জন্য আমরা ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ডেকেছিলাম। কারণ সুধী সমাবেশের দায়িত্ব চেয়ারম্যান ও মেম্বারদেরই দিতে হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে আমার বৈঠক হয়েছে তার আলোকেই এই মিটিংটি করা হয়েছে।’

পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে শপথ করানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই বৈঠকেই আলোচনা প্রসঙ্গে জেলা পরিষদ নির্বাচনের কথা উঠেছে। এখন কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে আমি কাকে ভোট দিবো, আমি তো চুপচাপ থাকতে পারবো না। আমি অবশ্যই আমার পছন্দের প্রার্থীর কথা বলবো। আমি কি অন্য প্রার্থীর কথা বলবো? তবে হাত উঁচিয়ে কোনও শপথ তো করা হয়নি। প্রয়োজনে আপনারা ওইদিনের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখুন।’ বলেন এমপি নদভী।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এমপি বলে কিন্তু কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। অভিযোগ পাওয়ায় ওনাকে (সাংসদ নদভী) ইতোমধ্যে আমরা শোকজও করেছি। দলবেঁধে যাওয়া, দেখিয়ে ভোট দেওয়া কিংবা অন্যকিছু করার সুযোগ চট্টগ্রামে থাকবে না, এটা আমি নিশ্চিত করছি। আপনারা ভোটের মাঠে গেলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন।’