মা’র কোলে বৃষ্টির মাথা। বৃষ্টির বুক থেকে নিচের অংশজুড়ে চাট করছে কবিরাজ। লজ্জায়, ক্ষোভে, অপমানে থেমে থেমে হাত-পা ছুঁড়ছে বৃষ্টি। মিলনটা নির্বিঘ্ন না হলে ভেস্তে যেতে পারে সমস্ত চিকিৎসা, তন্ত্র-মন্ত্র। সেই শঙ্কায় সমস্ত শক্তি প্রয়োগে মেয়েকে চেপে ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা মা মোহছেনার। মেয়েকে সান্ত্বনা দেন- এই তো, আর অল্প সময়। একটু ধৈর্য্য ধর মা। ততক্ষণে বৃষ্টির পা থেকে বুক পর্যন্ত চষে বেড়ায় কবিরাজ। মা-র চোখের সামনেই আধঘণ্টা ধরে বৃষ্টির সঙ্গে আদিম খেলায় মেতে উঠে ভণ্ড কবিরাজ জসিম উদ্দিন।
কচি মেয়ের কুমারিত্ব হরণের সে কি আনন্দ! চোখেমুখে তৃপ্তির রেখা কবিরাজ জসিমের। হা হা করে হাসছে আর বলছে অনেক কষ্টে কুমারিত্ব কেটে দিলাম। আজ থেকে এই ঘরে আর কোনো শনির দশা, অমঙ্গল থাকবে না।
অমঙ্গল তাড়ানোর শর্তে কুমারী মেয়ের সতীত্ব, সম্ভ্রম তুলে দিতে পেরে মা মোহছেনাও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঘরের সমস্ত অমঙ্গল পালিয়ে যাবে। ভর করবে না আর কোনো দুঃসংবাদ। বেকার ছেলের চাকরি হবে। থাকবে না অভাব-অনটন। এই আত্মতৃপ্তি কেবল মোহছেনার নয়, পরিবারের অন্য সদস্যেরও। কিন্তু ভালো নেই কেবল বৃষ্টি। একটু আগে যার কচি শরীরে সিডর-আইলা বয়ে গেছে সে ভালো থাকতে পারে না, থাকার কথাও নয়।
জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শ। সেই স্পর্শে যেন লাঙ্গল চালানো হলো বৃষ্টির যোনিপথে। যোনিপথে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি মনের রক্তক্ষরণ হচ্ছে সমানে। এ কী ঘটে গেলো জীবনে!। মনকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারে না বৃষ্টি।
সময়ের ফ্ল্যাশব্যাক করতে চায় বৃষ্টি। ফিরে যায় পারিবারিক আয়োজনে র্যাপড্ হওয়ার আগের মুহূর্তে। কেন সে মায়ের ডাকে কলেজের ক্লাস ছেড়ে ভরদুপুরে ঘরে এলো! মা এমন করে ডেকে পাঠালো মনে হলো
ধ্বংসের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে গোটা পরিবার। সে না এলে চূড়ান্ত সর্বনাশটা হয়ে যাবে। হন্তদন্ত হয়ে ফিরেই দেখে কবিরাজ জসিমকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছে মা।
কবিরাজি চিকিৎসা, বানটুনা, তাবিজ-কবজে মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের অগাধ বিশ্বাস বুদ্ধির বয়স থেকে দেখে আসছে বৃষ্টি। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিজের পেট থেকে জন্ম নেওয়া মেয়ের সম্ভ্রমকেও ছাপিয়ে যাবে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি সে।
মা বললেন, পরিবারের মঙ্গলের জন্য আজ তোকে যেটা বলব সেটা করতে হবে। বলেই কবিরাজের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই বৃষ্টিকে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যায় মা। বৃষ্টি বুঝে উঠতে পারে না তার সিদ্ধান্তটা কী হবে। দোটানার মাঝেই একের পর এক ঝরে পড়ে গর্ভধারিণী মায়ের আকুতি।
: তোর পায়ে পড়ি মা। ঘরে অসুখ-বিসুখ, অভাব অনটন লেগে আছে। তোর বড়বোনের বিয়ে হয়েও সংসারে সুখ পাচ্ছে না। সারাবছর বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। লেখাপড়া করেও তোর একমাত্র ভাইটা কোনো চাকরি-বাকরি পাচ্ছে না। তোর বাবার শিক্ষকতার উপার্জনে সংসারটা আর চলছে না। কবিরাজ বাবা তোর কুমারিত্ব কেটে দিলে আমাদের পরিবারে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। বলেই টান দিয়ে বৃষ্টির পায়জামার ফিতা খুলে ফেলে মা। মায়ের আবেগ, আহাজারির কাছে হার মানে বৃষ্টি।
মায়ের সামনে, মায়ের সহযোগিতায় বৃষ্টির ডগা শরীরে খায়েস মেটালো কবিরাজ জসিম। বাবা আলাওয়াল হোসেন বাসার ছাদে, বড় ভাই শুভ বারান্দায় আর বড় বোন ঝর্ণা রান্নাঘর থেকে বৃষ্টির কুমারিত্ব কাটানোর নির্মম দৃশ্যের সাক্ষী হয়। বৃষ্টি একবার ভাবে, চিৎকার করে পাড়ার লোকজন জড়ো করবে। কিন্তু সেটা করতে গেলেও বিপত্তি। লোকজন এসে কবিরাজের চামড়া তুলে নিবে তা শুধু নয়, নিশ্চিত গণধোলাই থেকে রেহাই পাবে না তার বাবা-মা, ভাই-বোনও। তাছাড়া ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে এই জীবনে কাউকে আর মুখ দেখানো যাবে না। তাই সেদিন কুমারিত্ব কাটানোর, সতীত্ব খোয়ানোর বুকফাটা কষ্ট চেপে যায় বৃষ্টি।
কিছুদিন আগেও জসিম কবিরাজ একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতো। চাকরির সুবাদে রংপুর থেকে দুই বছর আগে (২০০৫ সাল) যশোরের নিবারণ গ্রামে আসে সে। আলাওয়াল সাহেবের বাড়ির পাশে একটি ভাড়া বাসায় উঠে। জসিম উদ্দিনের স্ত্রী, দুই সন্তান রংপুরেই থাকে।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিবেশি আলাওয়াল সাহেব, তার স্ত্রী মোহছেনার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে জসিমের। প্রায় তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো জসিম। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে এক বাটি জসিমের কাছে পাঠাবেই গৃহকর্ত্তী মোহছেনা। এই খাতির, যতœ-আত্তির মাঝেই জসিমের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে মোহছেনার মেয়ে স্থানীয় বিদ্যানন্দিনী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অর্থনীতিতে মাস্টার্স পড়–য়া বৃষ্টির প্রতি। আকারে-ইঙ্গিতে বৃষ্টিকে পাওয়ার ইচ্ছার কথা জানানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু বরাবরই বৃষ্টি তাকে এড়িয়ে চলে। এক সন্ধ্যায় বাড়ির সামনে অন্ধকার গলিতে চলার পথে ইচ্ছা করে বৃষ্টির সাথে ধাক্কা খায় জসিম। সেদিন লুইচ্ছা, ইতরসহ অনেক গালাগাল শুনতে হয়েছিল তাকে।
কিন্তু চল্লিশোর্ধ জসিম দমে যাবার পাত্র নয়। যেভাবেই হোক বৃষ্টিকে তার পেতে হবে। ভোগ করতে হবে বৃষ্টির বাড়-বাড়ন্ত শরীর। এজন্য নানা ফন্দিফিকির শুরু করে সে। একদিন মাথায় আসলো কবিরাজ হলেই এটা কেবল সম্ভব। কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি বৃষ্টির পরিবারের সদস্যদের অন্ধবিশ্বাসের কথা জসিম ভালোভাবেই জানে। তাই ওষুধ কোম্পানির চাকরির অভিজ্ঞতা যুক্ত করে কবিরাজি চিকিৎসক হতে নেমে পড়ে সে।
এরইমধ্যে দূরসম্পর্কের একজন কবিরাজের সঙ্গে ওঠাবসা করতে গিয়ে কুফুরী-কালাম আত্মস্থ করে জসিম। এ সময়ে তার কয়েকজন সঙ্গী-সাগরেদও জোটে যায়। নানা কৌশলে সহজ সরল কিছু মানুষের আস্থা অর্জন করে জসিম।
কুমারী মেয়ে ছাড়া কোনো চিকিৎসায় কার্যসিদ্ধি হবে না, এমনটাই থাকতো তার কবিরাজির মূল শর্ত। শর্ত অনুযায়ী, কুমারী মেয়ে ছাড়া কোনো ধরনের চিকিৎসায় হাত দেয় না সে। লোক দেখানোর জন্য কুমারী মেয়েদের দিয়ে সে পুকুর থেকে পানি আনাতো। তাদের দিয়ে নানা রকম ভোজবাজির খেল দেখাতো। ভোজবাজির মারপ্যাঁচে বিভ্রান্ত হতো, আস্থা রাখতো সাধারণ মানুষ। বিপুল আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয় মোহছেনারও। ফলে খুব সহজেই নিজের কামনা-বাসনা পূরণ করার সুযোগ হাতে পেয়ে যায় সে।
একদিন ঝাড়ফুঁক করে মোহছেনার ঘরের আছড় তাড়াতে গিয়ে কবিরাজ জসিম জানায়, ঘরের অশুভ শক্তি সমূলে দূর করতে হলে কুফুরীর মাধ্যমে একজন কুমারী মেয়ের সঙ্গে সহবাস করতে হবে। এই কথা কোরআনের বাণীর মতো বিশ্বাস করে মোহছেনা। কিন্তু কুমারী মেয়ে পাবে কোথায়? মেয়ে বৃষ্টি ছাড়া এ মুহূর্তে আর কাউকে দেখছে না মোহছেনা। কিছুটা ইতস্তত বোধ, সিদ্ধান্তহীনতায়ও ভোগে।
দুশ্চিন্তার কী আছে। কুমারী মেয়ে তো আপনার ঘরেই আছে। এত চিন্তা করলে জিন্দেগিতেও আপনার পরিবারের সমস্যা যাবে না। দেরি করলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। সম্ভব হলে কাজটি এখনই সেরে ফেলুন- বলে জসিম।
মোহছেনা আর দেরি করে না। হাঁটাদূরত্বে বৃষ্টির কলেজ। বৃষ্টির কাছে বিদ্যুৎগতিতে খবর পাঠানো হলো। বলা হয়, ঘরে মহাবিপদ হয়েছে। এখনই যেন সে ঘরে ফিরে। ঘরের বিপদ। মায়ের ডাক। বসে থাকতে পারে না বৃষ্টি। জ্ঞানরঞ্জন স্যারের মজার ক্লাস বাদ দিয়ে ঘরে এসে দেখে বিপদ তাড়ানোর জন্য সাজানো র্যাপড-আয়োজন। সে আয়োজনে নিজেকে সপে দিয়ে শারীরিক, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে বৃষ্টি। প্রতি মুহূর্তে মানসপটে ভেসে উঠে নিজের কাছে নিজের পরাজয়ের দৃশ্যটি।
এক পর্যায়ে অস্বাভাবিকতা ভর করে নিজের মাঝে। নাওয়া-খাওয়া, পড়াশোনায় তাল হারিয়ে ফেলে। একা, নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঘরের মাঝেই কাটিয়ে দেয় টানা তিনমাস।
তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয় মার প্রতি, পরিবারের সদস্যদের প্রতি। তারাই যেন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ, চিরশত্রু। মানসিকভাবে কিছুতেই তাদের আর মেনে নিতে পারে না বৃষ্টি। তাদের কেউ সামনে পড়লেই লজ্জিত ও বিব্রধবোধ করে। বিশেষ করে মা-র সামনে পড়লেই কেমন যেন হয়ে উঠে বৃষ্টি। মানতে পারে না মায়ের সহযোগিতায় উলঙ্গ হওয়া, মা-র সামনে কুকুরের মতো নিজের শরীরে কবিরাজের ঝাঁপিয়ে পড়া, মা-র সামনেই যোনিপথে কবিরাজের পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করানোর দৃশ্যগুলো। এসব মনে পড়লে পৃথিবীটা অসহ্য, মিথ্যে মনে হয় বৃষ্টির কাছে।
তখন নিজেই নিজেকে অভিশম্পাত দেয়। ভাবে সে কলঙ্কিনী, ব্যর্থ, অপায়া, ধর্ষিতা, আশ্রয়হীনা। জন্মদাতা বাবা-মা’র সহযোগিতায় ধর্ষিতা হবার ঘটনা পৃথিবীতে বোধহয় একটিই। আর সেই একটি ঘটনার ভিকটিম সে নিজে। নিজেকেই ধিক্কার, নিন্দা জানাতে ইচ্ছে হয় তার। ভাবে মাস্টার্সে পড়ে, উদীচির মতো প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে কী লাভ- কুসংস্কারের কাছে যদি সম্ভ্রমের পরাজয় ঘটে!
অথচ এর আগে পাড়ার রোমিও, বখাটে এক ছেলের ইভটিজিং বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা করেছে বৃষ্টি। ওই অঞ্চলে তখন উদীচির সাংগঠনিক ভিত্তি তুঙ্গে। সংগঠনের কর্মীরা একে অপরের জন্য যথেষ্ট হেল্পফুল। বৃষ্টি ভাবে- এলাকার প্রভাবশালী ইভটিজারের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে হলে উদীচির সঙ্গে যোগাযোগটা বাড়িয়ে দিতে হবে। সক্রিয় হতে হবে তাদের সাংগঠনিক কর্মকা-ে। ওয়েল অর্গানাইজড সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হয়েই অনেক শুভার্থী, বন্ধুবান্ধব জোটে যায়। মিছিল-মিটিং, সাংস্কৃতিক পরিম-লে সঙ্গটা বেশ ভালোই কাটে বৃষ্টির। পাড়ার ধনী লোকের ছেলে নিলয়ের যন্ত্রণা যখন বেড়ে যায় তখন বৃষ্টির সংগঠনের ছেলেরাই তা সামাল দেয়। একবার তো নিলয়কে মেরে ভর্তা বানিয়ে দিয়েছিলো তার সহপাঠীরা। সে থেকে নিলয় আর কখনো বৃষ্টির দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।
কবিরাজের লালসা থেকে বাঁচার জন্য কেন সে সংগঠনের ছেলেদের সহযোগিতা নিলো না? কেন সে র্যাপড-আয়োজন থেকে পালিয়ে গিয়ে সহপাঠীদের দ্বারস্থ হলো না? তা করলে কী ভয়াবহ অবস্থা হতো তাও একবার কল্পনা করার চেষ্টা করে বৃষ্টি। কবিরাজের বারোটা বাজতো ঠিকই; কিন্তু তার পুরো পরিবারই সমাজের প্রতিপক্ষ হয়ে যেতো। চিরদিনের জন্য নিন্দিত, ঘৃণিত হয়ে থাকতো মানুষের কাছে। ভাবে- পরিবারের সবাইকে ধিকৃত, নিন্দিত না করে সে একজনই না হয় নিন্দিত থাকলো, অচ্ছুৎ থাকলো আজীবন। নিজেকে বলির পাঁঠা করে বাকিরা সবাই ভালো থাকুক। থাক, নিজেকে না হয় উৎসর্গই করলো পরিবারের জন্য।
বৃষ্টির ধারণা, সে না বললে বাইরের কেউ কোনোদিনই তার ধর্ষিতা হওয়ার খবর জানবে না। ধর্ষণের আগে বুকে কোরআন চাপিয়ে বাইরের কাউকে না জানানোর শপথ করালো যে কবিরাজ সেও নিশ্চয় কাউকে জানাবে না। বৃষ্টির পরিবারও এ নিয়ে কোনোদিন মুখ খুলবে না।
তাতে কী! বৃষ্টি তো জানে সে ধর্ষিতা, নষ্টা মেয়ে। নিজের রুচিবোধের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ, বিবেকের কাছে দংশিত, কলঙ্কিত সে! সে জানে এই কলঙ্কের বোঝা নীরবেই তাকে বয়ে বেড়াতে হবে মৃত্যুপর্যন্ত। তাই ইজ্জতের আত্মহননের পর একবার জীবনের আত্মহননের পথও বেছে নিতে চেয়েছিল বৃষ্টি। অবশ্য নিজেই সে পথ থেকে আবার ফিরে আসে।
নিজের কাছে নিজের ধিক্কার সঙ্গী করেই ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প করে বৃষ্টি। ৬ মাস ঘরকুনো থাকার পর জনমানুষের সামনে আসে। পিছিয়ে পড়া লেখাপড়া এগিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয়। মাস্টার্স ফাইনাল সন্নিকটে। নিয়মিত ক্লাশ, নোট সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নিতে থাকে জোরেশোরে। যেভাবেই হোক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে। পড়াশোনা আর সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থেকে মনের রক্তক্ষরণ থামাতে চায় বৃষ্টি, ভুলতে চায় ধর্ষিতা হওয়ার সেই দুঃসহ স্মৃতি।
পরীক্ষা শুরু হয় যথারীতি। প্রতিটি পরীক্ষাই ভালো হচ্ছিল। আর একটি মাত্র পরীক্ষা বাকি। মাঝখানে দুইদিন বিরতি। এর মাঝেই ক্লাশের সহপাঠী শুভ্র’র ঘৃণামিশ্রিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় বৃষ্টিকে।
ছিঃ তুমি, তোমরা এতো নিচে নামতে পারো। অর্থের জন্য কবিরাজ জসিমের কাছে নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দিতে পারো।- শুভ্র’র এমন কথায় মাথা ঘুরে যায় বৃষ্টির। সত্যি সত্যি ঘুরছে পুরো পৃথিবী। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বৃষ্টি।
: শুভ্র এসব কী বলছো তুমি?
: আমি নই, কবিরাজই বলে বেড়াচ্ছে তোমার মা তোমাকে নিয়ে দেহব্যবসা খুলে বসেছে। তোমাদের বাড়িটা নাকি এখন সুরক্ষিত পতিতালয়। কবিরাজ জসিম ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তোমাকে ভোগ করেছে। একথা সে জনে জনে বলছে। বলছে, বাইরে এত বড়াই করে যে মেয়ে (বৃষ্টি) ঘরে সে আধুনিক পতিতা।
কবিরাজ তাহলে ফাঁস করে দিলো ঘটনা! কিন্তু সে তো কবিরাজের লালসার শিকার! এখানে পতিতা, অর্থ এসব আসলো কেন। বৃষ্টি ভাবে, পতিতা না হলেও সে তো একদিন কবিরাজের ভোগ্যপণ্য হয়েছিল- তা তো মিথ্যা নয়। তাই সে কথা বাড়াতে চায় না। শুভ্র’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছে। পৌঁছেই মুখোমুখি হয় মা মোহছেনার।
: মা, আমি মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। কবিরাজ আবার নতুন সর্বনাশে মেতেছে। সে বলে বেড়াচ্ছে আমাকে দিয়ে তুমি দেহব্যবসা করছো। ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সে আমাকে ভোগ করেছে। কী করে আমি বাঁচবো বলো। নতুন করে বাঁচার স্বপ্নটাকেও সে ধর্ষণ করতে চায়। বলেই মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকে বৃষ্টি।
: আমাদের ক্ষমা করে দেয় মা। সারাজীবন প্রায়শ্চিত্য করলেও এই পাপ মোচন হবার নয়। ভ- কবিরাজের ফন্দিফিকির আমরা বুঝতে পারিনি। মঙ্গলের আশায় তার ফাঁদে পা দিয়ে তোর সর্বনাশ করেছি, সর্বনাশ করেছি আমাদের। সে থেকে পরিবারে অশান্তি, কুফা লেগেই আছে। একের পর এক সঙ্কট, অভাব ভর করে আছে পরিবারে। একনাগারে বলে যায় বৃষ্টির মা।
দুইটা দিন কীভাবে পার হলো বৃষ্টি জানে না। বাকি পরীক্ষাটা আজ সকাল ১০ টা থেকে। পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার নেই। তাছাড়া গত দুদিন এক সেকেন্ডের জন্যও বই নিয়ে বসতে পারেনি বৃষ্টি। আগের পরীক্ষাগুলো ভালোই হয়েছে। এই একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলে জীবনের অভিশাপ থেকে একধাপ উতড়ে যাওয়া যেতো।
স্থির হয়ে দাঁড়ালো বৃষ্টি। পরীক্ষা সে দেবেই। রিভিশন দিতে না পারলেও আগের পড়া তো আছে। উত্তরপত্রে কিছু অন্তত লেখা যাবে। চটজলদি কাপড় বদলিয়ে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায় বৃষ্টি। দৌড়ঝাঁপ করে পরীক্ষা হলে পৌঁছে। কিন্তু ততক্ষণে ১০টা ১০ মিনিট। মানে ১০ মিনিট ওভার। বহু চেষ্টায় ৭৫ মার্কস-এর উত্তর লিখতে সক্ষম হয় বৃষ্টি। এ বিষয়ে পাশ করবে সে নিশ্চিত। কিন্তু কোনোরকমে পাশ করাটা এভারেজে তার ভালো রেজাল্টের পথে কাঁটা হবে নির্ঘাত। বৃষ্টি ভাবে, ফার্স্ট ক্লাশ বড় কথা নয়, পরিস্থিতি যা হয়েছে মাস্টার্সের গণ্ডি পার হওয়াটাই জরুরি। আর তা পার হতে পারলে বাঁচার নতুন কোনো পথ হয়তো খুলে যাবে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই বৃষ্টি চলে যায় পুরান ঢাকায় বড় বোনের বাসায়। সাথে মা মোহছেনা। কিছুদিন নিরিবিলি, একা থাকতে চায় বৃষ্টি। কিন্তু সেখানেও নতুন সঙ্কট, নতুন রক্তক্ষরণ। কবিরাজের ঘটনা এরমধ্যে দুলাভাই রহিম উল্লাহও জেনেছে। যে-ই বৃষ্টিকে কাছে পেলো তখনই তার মাঝে ভর করলো কামুক লালসা। কবিরাজ ভোগ করতে পারলে সে পারবে না কেন। বরং শ্যালক হিসেবে তার অধিকারটা বেশি!
যে দুলাভাইকে বড়ভাইয়ের মতো জানত, শ্রদ্ধার চোখে দেখতো সেই কিনা নজর দিলো বৃষ্টির শরীরে। বেডরুমে, বাথরুমে, বারান্দায় একাকি পেলে জড়িয়ে ধরে, জোর করে চুমু খেতে চায় দুলাভাই দুলাল। প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক বড় বোনের সদ্য পোস্টিং যশোরের শার্শা উপজেলায়। সেকারণে দুলাভাই একাই থাকতো বিশাল এই বাড়িটাতে। দুলাভাইয়ের বাড়িতে অতিথি কেবল বৃষ্টি ও তার মা মোহছেনা।
মাকে সহ্যই করতে পারছিলো না বৃষ্টি। তাই দুলাভাইয়ের বাসায় আলাদা একা একাই থাকে বৃষ্টি। আর সে সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে দুলাভাই দুলাল। দিন যত যাচ্ছে দুলাভাইয়ের লোলুপ দৃষ্টি তত প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। সুযোগ পেলেই কবিরাজের প্রসঙ্গ টেনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বৃষ্টির শরীরে। যেন সরকারি মাল, সরকারি আকাশ! কিন্তু বৃষ্টি কোনোভাবেই তার আকাশকে সরকারি হতে দেবে না, দিতে পারে না। এখানে সে নিরাপদ নয়। তাই কোনোরকম আত্মরক্ষার চেষ্টা করে বৃষ্টি পালাতে চায় এখান থেকেও। ভাবছে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমাবে। কিন্তু চোখে পড়ার মতো ‘শরীর’ নিয়ে বৃষ্টি যাবে কোথায়। সিদ্ধান্ত নিলো গ্রামের বাড়ি নিবারণেই ফিরে যাবে। যতদিন সম্ভব সেখানে থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।
আগের রাতে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। মাকে বলে দিয়েছে সকালে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার কথা। মা বলে, এমন একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল ফেলে বাড়ি যাবি। সেখানেও তো ভালো থাকবি না।
পাড়া-মহল্লায় নানা কথা, গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। এসব তুই সইতে পারবি না। বলেই বাধ সাধে মোহছেনা। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ সেই কথা মাকে বলতে পারে না বৃষ্টি। যেই মা কবিরাজের হাতে মেয়ের শরীর তুলে দিতে পারে সে মা-র কাছে দুলাভাইয়ের লাম্পট্যের কথা বলেই বা কী লাভ! সম্ভ্রমের বড়াই করার জায়গাটি সেদিনই তো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই প্রতিবাদ কিংবা কাউকে কিছু না জানিয়ে নীরবে আত্মরক্ষাটাই শ্রেয় হবে।
কোনো ব্যাখ্যা কিংবা কথা না বাড়িয়ে বৃষ্টি রওয়ানা দেয় গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। সঙ্গী মা মোহছেনা। বাড়ি পৌঁছে আবারও ঘরবন্দী হয় বৃষ্টি। ঘরে মা-বাবা, ভাই-বোন কারো সঙ্গে কথা হয় না। তারাই তার প্রতিপক্ষ, চিরশত্রু, ইজ্জত লুঠেরার সহযোগী। তৈরি হওয়া তীব্র ঘৃণাবোধই পরিবারের সদস্য থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। ঘরে সে একাই। ইচ্ছা হলে খায়, ঘুমাতে যায়।
তাই কখনো কখনো অসহ্য লাগে চারপাশ। এসময় তার মনে হলো একটা সঙ্গ দরকার। কিন্তু সঙ্গ পাবে কোথায়। মনে পড়লো কলেজজীবনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী স্বর্ণালীর কথা। পুরনো নোট বুক খোঁজে বের করে স্বর্ণালীর গ্রামীণ ফোনের নাম্বারটি। নাম্বারটি এখন ব্যবহার করে কিনা! সংশয় নিয়ে ফোন করে বৃষ্টি।
: এটা কি স্বর্ণালীর নাম্বার?
: আপনি কে বলছেন?
: আমি স্বর্ণালীর বন্ধু, বৃষ্টি
: বৃষ্টি! এতদিন পর কোত্থেকে তুই। কত খুঁজেছি তোকে। কিন্তু কেউ তোর নাম্বারটা দিতে পারলো না। বল কেমন আছিস, কোথায় আছিস।
: আছিরে কোনো রকম। মাস্টার্সপরীক্ষা শেষ হয়েছে। ঘরে সময় কাটে না। ভালো লাগে না কিছুই। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে তোকে খুঁজে নেওয়া।
: বেশ ভালো, যখনই ইচ্ছা আমাকে ফোন করবি। তোর সাথে কথা বললে আমারও ভালো লাগবে।
: কী করিস এখন?
: হোম মিনিস্টার!
: মানে?
: সংসারের দায়িত্ব পালন করি। স্বামী-সংসার, এক সন্তান নিয়ে চলে যাচ্ছে দিন। উত্তরায় থাকি। একবার ঘুরে যা আমার বাসা থেকে। ভালো লাগবে।
: কিন্তু তোর বিয়ে হলো কখন?
: বলিস না আর। তিতুমির কলেজ ফিলোসপিতে অনার্স পড়ছিলাম। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে না হতে পরিবারের অনুরোধে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। ভালোই আছি আল্লাহর রহমতে। ছয়মাস বয়সী ফুটফুটে একটা বাচ্ছাও আছে আমার। দোয়া করিস।
এরপর প্রায় কথা হতো বৃষ্টি-স্বর্ণালীর। স্বর্ণালীর টেলিফোন-সাহচর্যে মোটামুটি ভালোই কাটছে বৃষ্টির দিন। এক সন্ধ্যায় টেলিফোনে দুজনের কথা হচ্ছে। স্বর্ণালী বাসার ছাদে। নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে বৃষ্টির কথা ঠিকমতো বুঝতে পারে না। অগত্যা লাউড স্পিকার অন করে স্বর্ণালী। এভাবেই দেবর-ননদ ও প্রতিবেশি কয়েকজনের সামনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় বৃষ্টি-স্বর্ণালীর।
বৃষ্টির ভয়েস ভারি সুন্দর। কিন্তু টেলিফোন যন্ত্র হয়ে যখন এ ভয়েস আসে তখন তা অনবদ্য হয়ে বাজে কানে। শুনতে যে কারো ভালো লাগে। প্রতিবেশি রেজাও তন্ময় হয়ে শুনেছিল সেদিন বৃষ্টির ভয়েস। পরদিনই রেজা হাজির একই ভবনের বাসিন্দা স্বর্ণালীর কাছে।
: ভাবী, আপনার বান্ধবীর সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। তার ভয়েসে আমি যারপরনাই মুগ্ধ। প্লিজ তার সঙ্গে আমাকে একটিবার কথা বলিয়ে দিন।
স্বর্ণালী ভাবে, হ্যান্ডশাম একটা ছেলে, ৬ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, স্মার্টনেস কোনো কিছুতেই ফেলনা নয়। বৃষ্টিও যদি পছন্দ করে তাহলে ভালোই হবে। বৃষ্টি দারুণ সঙ্গপ্রিয়, উচ্ছ্বল এক মেয়ে। মানসিক যন্ত্রণায়, নিঃসঙ্গতায় জীবনটা তার হাফিয়ে উঠেছে। হূমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘সঙ্গপ্রিয় মানুষের জন্য নিঃসঙ্গতা অনেক বড় শাস্তি, কঠিন শাস্তি।’- এসব ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টিকে ফোন দেয় স্বর্ণালী।
: কেমন আছিস?
: আছি বেশ।
: তোর কথাই ভাবছিলাম। ভাবছি একটা ফোন দেবো, কথা বলে মনটা হালকা করবো। কী টেলিপ্যাথি! তুই-ই ফোন দিয়ে দিলি। একেই বোধহয় বলে মনের টান।
: ভাবছি তোর নামে ফ্যানক্লাব খুলবো
কিনা। বৃষ্টি-ফ্যানক্লাব।
: মানে!
: কাল লাউড স্পিকারে ভয়েস শুনে আমাদের বিল্ডিংয়ের সবাই তোর ভক্ত হয়ে গেছে। ধর নেয়, এক ভক্তের সঙ্গে কথা বল।
-স্লালামালেকুম। আমি রেজা। স্বর্ণালী ভাবির পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। কাল সন্ধ্যায় ভাবির সঙ্গে আপনার কথোপকথন, আপনার কণ্ঠ আমার লেগেছে বেশ। দারুণ বলেন! একেবারে প্রেজেস্টেশন, আবৃত্তির গলা, প্রমিথ উচ্চারণ। একনাগারে কথাগুলো বলে যায় রেজা।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় বৃষ্টি। ওমা বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে একটা ছেলের সঙ্গে ধরিয়ে দিলো। মনে মনে স্বর্ণালীর উপর একটু রাগও হয় বৃষ্টির।
: বিব্রত করছি কি? যদি তাই হয়, ক্ষমা করবেন।
: না না, তেমন নয়।
: আমার আর তেমন কথা নেই। আপনার মায়াবী ভয়েসে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার গল্পটাই মূলত জানাতে চেয়েছিলাম। ভালো থাকুন, বলেই ফোনটা স্বর্ণালীর কাছে দিয়ে দেয় রেজা।
সামান্য আলাপেই রেজার স্মার্টনেটস, ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে বৃষ্টির কাছে। ভালো লাগার দ্যোতনা তৈরি করে হৃদয়ে। স্বর্ণালী থেকে নাম্বার নিয়ে পরদিন বৃষ্টি নিজেই ফোন দেয় রেজাকে।
: কেমন আছেন।
সুমধর কণ্ঠে কুশল জানতে চাইছে এক নারীকণ্ঠ। ঘোর কাটে না রেজার। কিন্তু বুঝে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি বৃষ্টির কণ্ঠ। বৃষ্টি নিজ থেকে ফোন দিয়ে তার কুশল জানতে চাইবে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি রেজা। ভেতরে আনন্দের অনুরণন বেজে ওঠে। বয়ে যায় অপরিমেয় প্রাণসুধা।
: জ্বি, ভালো
: চিনতে পেরেছেন?
: যার কথায়, কণ্ঠে মধু ঝরে, কথা বললেই গান হয়ে ওঠে, সুর হয়ে বাজে তাকে চিনব না?
: ওরে বাবা, আপনি তো দেখি দারুণ কাব্যিক মানুষ।
: ও প্রান্তের মানুষটা যদি হয় কাব্যের উপাদান এ প্রান্তের মানুষ তো কাব্যিক হতেই পারে।
: বাহ, চমৎকার বলেন তো!
: চমৎকার যার কথামালা, চমৎকৃত হওয়ার মতো যার উপস্থাপনা তার কাছে সবই চমৎকার লাগে।
: আপনার সঙ্গে কথাই পারা যাবে না। আপনি কথাজীবী, কথাসাহিত্যিক।
হৃদয়ের ক্ষরণ থামাতে একজন মানুষের প্রয়োজন বৃষ্টির। সেই মানুষটি হতে পারে রেজা। বৃষ্টি ভাবে তীব্র খড়ার মাঝে এ যেন এক পশলা বৃষ্টি। আল্লাহ মেঘ দেয়, পানি দেয় ছায়া দে রে তুই। বিধাতা ছায়া দিয়েছেন। এই ছায়াতলে ঘুরে দাঁড়াবে বৃষ্টি।
বৃষ্টির মনে স্থায়ী বসত হয়ে যায় রেজার। সেই থেকে বৃষ্টি-রেজা একে অপরের। প্রতিদিন কথামালার সুতোই বাঁধতেন তারা। হারিয়ে যেতেন অপার ভালোবাসা, ভালোলাগায়। বৃষ্টিবিহীন একটা দিনও কাটে না রেজার। একই অবস্থা বৃষ্টিরও। রেজার রৌদ্রোজ্জ্বল তাপে নিজেকে শুকাতে চায় বৃষ্টি। চারপাশ অন্ধকার করে, আকাশ ভারি করে নাগরিক জীবনে যে বৃষ্টি নামে রেজার প্রাত্যহিক জীবনে সেরকম বৃষ্টি হয়ে আসে না বৃষ্টি। মিষ্টিময় রোদ-বৃষ্টির মিতালিতে ভালোই যাচ্ছিল বৃষ্টি-রেজার সময়গুলো। সুযোগ পেলেই ফোনে কথা বলে তারা। তবে কথা বলার জন্য দিনের বেলাকেই প্রায় বেছে নিতো রেজা।
বৃষ্টির বাবা-মার সাথেও কথা বলতো, টেলিফোনে তাদের কেয়ার নিতো রেজা। ফলে বৃষ্টি শুধু নয়, তার বাবা-মার কাছেও দায়িত্বশীল, মানবিক ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠে রেজা। আর সেই ছেলেটা যখন তাদের মেয়ের ‘বর’ হতে চায় তখন স্বাভাবিকভাবেই ভালো অনুভূতি তৈরি হবে তাদের মাঝে তাই স্বাভাবিক। বৃষ্টিও দারুণ খুশি। দুজনে সুখের তাজমহল করবে-মনে মনে ভাবে বৃষ্টি।
হ্যাঁ, রেজা এবার বউ করে পেতে চায় বৃষ্টিকে, বৃষ্টিও আকুল হয়ে রেজাকে চায়। এই ৬ মাসে একটিবারের জন্যও কেউ কাউকে দেখেনি। টেলিফোনেই সীমাবদ্ধ তাদের প্রেমালাপ।
সাংঘাতিক পাগলপারা দুজন। রেজা ইচ্ছা করলেই সবকিছু উজার করে দিতে প্রস্তুত বৃষ্টি। কারণ এই রেজাই বৃষ্টির অন্ধকার জীবনে আলো হয়ে এসেছিল। কিন্তু রেজা সংবেদনশীল। বৃষ্টির কণ্ঠে এতটা মুগ্ধ যে চেহারা না দেখেই বৃষ্টিকে বিয়ে করতে চায় রেজা। বিয়ের আগে বৃষ্টিকে দেখবেই না পণ করে রেজা। কয়েকদিনের মধ্যে বিয়েটা সেরে ফেলতে চায় সে।
বৃষ্টির বাবা মা একপায়ে খাড়া রেজার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে। কিন্তু যত আপত্তি রেজার পরিবারে। রেজার মা থাকলেও বাবা নেই। বাবা মারা গেছেন অনেকে আগে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে রেজা ছোট। একমাত্র বোন কল্পনা স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় থাকে। উত্তরার বাসাটাতে থাকে রেজা ও তার মা। আমেরিকা থেকে তাদের খরচ জোগান কল্পনা। মাস শেষ না হতেই মায়ের অনলাইন অ্যাকাউন্টে ঘর খরচের টাকা ঢুকে যায়।
বড় বোন কোনোভাবেই রাজি নয় এই বিয়েতে, মারও মত নেই। লেখাপড়াটাও কমপ্লিট করলো না, বেকার ছন্নছড়া জীবন রেজার। এই জীবনে একজন নারীকে এনে বোঝা করার কোনো মানে হয় না।
কিন্তু পরিবারের কোনো কথা শুনতে রাজি নয় রেজা। বৃষ্টিকে হারাতে চায় না সে। বৃষ্টিকে ফোন করে জানিয়ে দেয় কাউকে লাগবে না। কোনো আনুষ্ঠানিকতার দরকার নাই। আগামী শুক্রবার কাজী ডেকে বিয়ে হবে। যশোরের নিবারণে বৃষ্টিদের এলাকার পরিচিতি কাজী অথবা ঢাকার যে কোনো স্থানে বিয়ে পড়ানোর কাজটি হতে পারে। ঢাকার অপশনটাই বেছে নেয় বৃষ্টি। টঙ্গি এলাকায় রেজার এক পরিচিত মানুষের অফিসে আকদ্ ও বিয়ে পড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। ঠিকানা ধরে যথারীতি অফিসটাতে পৌঁছে গেলো বৃষ্টি। সঙ্গে বাবা-মা। রেজাও পৌঁছে গেছে আগেভাগে। কাজীকে ফলোআপ করে অফিসে একটু মিষ্টিমুখেরও ব্যবস্থা করে রেজা।
আছরের নামাজের পরপরই বাবা-মাকে নিয়ে অফিসে প্রবেশ করে বৃষ্টি, মাথায় টুপি, মুখে দাঁড়িসহ চারজন বসা অফিসে। একজন কাজী, আর তিনজনের মধ্যে রেজার দুই বন্ধু হলে তাহলে রেজা কোনটা? দেখতে শুনতে মন্দ না, লম্বাচওড়া রেজা সম্পর্কে এমন এক ফিরিস্তি জানা আছে বৃষ্টির। কিন্তু কমসে কম ৬ ফুট ১-২ ইঞ্চি লম্বা, চমৎকার চেহারা সৌষ্টব, উজ্জ্বল রঙ-এর নায়কোচিত যুবকটাই কি তাহলে রেজা! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই সামনে এসে দাঁড়ালো রেজা। স্বাগত জানায় বৃষ্টি ও তার বাবামাকে। সালাম দিয়ে বলে আমিই রেজা। এত সুন্দর, সুদর্শন রেজা! কল্পনার ছবিতে আঁকা রেজার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর বাস্তবের রেজা।
রেজাও মূলত বৃষ্টির কণ্ঠ- সেই সুরলহরীর প্রেমে মেতেছিলো, মজেছিলো। তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছে রেজা। বলেছিল যার কণ্ঠ এত সুন্দর, এত কোমল, এত প্রাণবন্ত তার বাহ্যিক সৌন্দর্য না থাকুক, পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত হলেও তাকে বিয়ে করবে সে। কিন্তু আজ বাস্তবের বৃষ্টি অন্য এক বৃষ্টি, অনন্য সাধারণ। ডাগর চোখ, চমৎকার চেহারা। দুজন দুজনার কাছে অনেক বেশি সুন্দর, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু। দুজনেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, সৃষ্টিকতার কাছে পরম কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
কাজীর বিবাহ রেজিস্ট্রির আনুষঙ্গিতার পর মাওলানা সাহেব আকদ্ পড়ালেন। বিয়েপর্ব
শেষ হলো। বৃষ্টি বাবা-মার সাথে যশোর চলে গেলো। বৃষ্টির বেশ ইচ্ছে হয়েছিলো কটা দিন রেজার সঙ্গে কাটাবে। রেজার সীমাবদ্ধতা সে বোঝে। দৃশ্যমাণ কিছু করে না রেজা। তাছাড়া বাবা-মার অমতে এই বিয়ে। কাজেই এ অবস্থায় কোথায় নিয়ে যাবে, রাখবেই বা কোথায়! এসব ভেবে বৃষ্টির উল্টো মায়া হয় রেজার জন্য। যদি উপায় থাকতো রেজাকেই সঙ্গে নিয়ে যেতো বৃষ্টি। কিন্তু বাড়িতে নিয়ে গেলে প্রতিবেশিদের নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হবে তাদের।
শারীরিকভাবে হয়তো কাছে নেই। মানসিকভাবে তো আছে সবসময়। তাছাড়া সারাজীবন একসঙ্গে থাকার নীল চুক্তিটা তো হয়ে গেছে। সমাজের কাছে ঘৃণিত, অবহেলিত, সম্ভ্রমহারা জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। বিশাল এই তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে বৃষ্টি।
বাবা-মাও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। এত সহজে, দ্রুততম সময়ে বৃষ্টির জীবনের একটা গতি হবে, সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা কল্পনাও করেনি তারা। বিধাতার কাছে শোকরিয়া জানান রেজার মতো বিনয়ী ছেলের কাছে মেয়ের নির্ঞ্ঝাট বিয়ে দিতে পেরে। রেজার অভিষেকে বৃষ্টির জীবন পাল্টে যাওয়া, স্বতঃস্ফূর্ততার বান তৈরি করার বিষয়টি বৃষ্টির বাবা-মাও বেশ উপভোগ করে। তাদেরই কৃতকর্মে ‘ছাইভস্ম সতীত্ব’ নিয়ে মেয়েটি পুরো জীবনেই যেখানে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা নয়, অল্পসময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ সত্যিই নতুন করে আশাবাদি করে তুলেছে বৃষ্টির বাবা-মাকে।
এদিকে বৃষ্টি-রেজা লিখিতভাবে স্বামী-স্ত্রী হয়েছে ৬ মাস। এর মধ্যে একবারও মুখোমুখি, চোখোচুখি হয়নি তারা। হয়নি বললে ভুল হবে। ইচ্ছা থাকলেও নানান সীমাবদ্ধতা তাদেরকে একজায়গায় হতে দেয়নি। এই সীমাবদ্ধতাটা অবশ্য রেজার বেশি। বৃষ্টিকে নিয়ে যাওয়া কিংবা ঘরে তোলার কথা বললে কেন জানি বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে রেজা। তাতে কিছু মনে না করে বরং সবসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রেজাকে এগিয়ে দেওয়ায় ব্রত বৃষ্টি। যে কারণে স্বাধ, ইচ্ছা, আহ্লাদের বিষয়গুলো সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে বৃষ্টি। আর কিছু না হোক কথা বলার একজন সঙ্গী, ভালো বন্ধু তো জুটলো তার। যে বন্ধু পোড়া সতীত্বের মাঝে তার নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা। ছাইয়ের স্তূপ হতে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠার গল্প।
দিন যত যায় ততই বৃষ্টির মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। আপন করে পেতে চায় রেজাকে, মায়াময় ছন্দে জীবনের ছড়া লেখার কাজটি এখনই শুরু করতে চায় বৃষ্টি। ছড়ার প্রতিটি বর্ণ, বাক্য হবে প্রেমের, আবেগের, রোমাঞ্চের।
অনেক আকুতির পর বৃষ্টিকে উত্তরার বাসায় তুলতে মার সম্মতি পেল রেজা। বৃষ্টিকে জানিয়ে দিলো মা রাজি হয়েছে, তোমাকে নিয়ে আসতে বলেছে। শুক্রবারই চলে এসো তুমি। এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে তোমাকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে যাবো।
খুশিতে আত্মহারা বৃষ্টি। শ্বশুরবাড়ি যাবে! সীমাহীন আনন্দ, অনুভূতি। অনুভূতির রঙগুলোও অন্যরকম। বৃষ্টি বউ হয়েছে প্রায় একবছর। কিন্তু বউ হিসেবে শ্বশুরবাড়ি এই প্রথম। তাই বউ সেজেই শ্বশুরবাড়ি যেতে চায়। বউ সেজে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ছোটবেলার সেই লালিত-আশ্রিত স্বপ্নটিও পূরণ হয়ে যাবে এই ফাঁকে।
এর মধ্যে পরিচিত এক ভাবির কাছ থেকে ধার করে এনেছেন লাল বেনারসিটা। সেটা পরেই শুক্রবার সকাল সকাল শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় বৃষ্টি। বিকেল ৪টায় এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামতেই হাত বাড়িয়ে দেয় রেজা। হাতের স্পর্শে অন্যরকম পুলক অনুভব করে বৃষ্টি। মনে হচ্ছে এই স্পর্শে পৃথিবীর সকল শক্তি, ভালোবাসা লুকিয়ে আছে।
এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে উত্তরা ৪ নং সেক্টর খুব বেশি দূরে নয়। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বপ্নের শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে যায় বৃষ্টি। কাজের মেয়ে দরজা খোলে। বৃষ্টিকে মা-র রুমে নিয়ে যায় রেজা। শাশুড়িকে সালাম করে আদবের সঙ্গে। ঘরে একজন নতুনের আগমনে যে উচ্ছ্বাস থাকার কথা সেরকম কিছু নেই শাশুড়ির মাঝে। বেশ রাশভারি মানুষ মনে হলো শাশুড়িকে। প্রথমদিনেই বৃষ্টি বুঝতে পারে এই ঘরে টিকতে হলে যুদ্ধটা অনেক কঠিন হবে। যাই হোক একটু আশ্রয়, একটু স্বীকৃতি পেলেই চলে বৃষ্টির। লাঞ্ছনা, অবহেলার কত জঘন্য রূপই তো মা-র সূত্রে পেয়েছে, দেখেছে সে। এ আবার তেমন কী! রেজার একটু মায়া পেলে অসাধ্যকে সাধন করতে পারবে বৃষ্টি।
কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই সহসা বিষিয়ে উঠে বৃষ্টির জীবন। সংসারের রান্না-বান্না, কাপড় ধোয়ার দায়িত্বটা তিন দিনের মাথায় বৃষ্টির কাঁধে চাপিয়ে দেয় শাশুড়ি জোবাইদা। কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ থাকতো না, যদি একটু স্বীকৃতি মিলতো। সারাদিন খাটুনির পরও শাশুড়ির কাছে মুখের শান্তি বলতে যেটা বোঝায় এক মিনিটের জন্যও পায় না বৃষ্টি। একজন
গৃহপরিচারিকার যে সম্মান, সেটুকুও জোটে না বৃষ্টির কপালে। পান থেকে চুন খসলে তুলকালাম কা- ঘটিয়ে ফেলে শাশুড়ি। খাওয়া-দাওয়ায় অঘোষিত বিধিনিষেধ। উচ্ছৃষ্ট, বাসি খাবারই বৃষ্টির আহার। আমেরিকা থেকে বেড়াতে আসা রেজার বড়বোন কল্পনার দৃষ্টিভঙ্গিও একইরকম। বৃষ্টি যেন তাদের ঘরের কাজের মেয়ের চেয়ে নিচুস্তরের। বাসার সবাই ঘটা করে ‘এসো বসো আহারে’ মিলিত হলেও সেখানে থাকা হয় না বৃষ্টির।
যার আশায়, যার টানে এই ঘরে আসা সেই রেজার মাঝেও কেমন যেন পরিবর্তন! তার সঙ্গ, প্রেম-রোমাঞ্চে মেতে থাকা দূরের কথা, সুখ-দুঃখ শেয়ার করার জন্যও রেজাকে পায় না। রাত করে বাসায় ফেরা, তারপর ধপাস করে শুয়ে পড়ে দুপুর পর্যন্ত অঘোরে ঘুমানো রেজার নিত্যরুটিন। দিনের ২টায় ঘুম থেকে উঠে টেবিলে রাখা খাবার খেয়ে বিকেলে আবারও বেরিয়ে যায় রেজা। প্রেমিক স্বামীর কাছে, প্রেমময় দাম্পত্যজীবনে একজন নতুন নারীর যে চাহিদা সেই চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখার সময়টুকুও নেই রেজার। এসব চাহিদা নিয়ে কথা বললেই ক্ষেপে যায় রেজা। রেজার এমন পরিবর্তন, এমন চেহারায় বৃষ্টি রীতিমতো হতবাক। এ কোন রেজা! এই রেজাকেই কি সে মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলো, স্বপ্নের পুরুষ ভেবেছিলো!
এর মধ্যেই বৃষ্টি আবিষ্কার করে সর্বনাশী মাদক রেজাকে খেয়ে ফেলেছে। মাদকের নেশায় ছুটতে গিয়ে স্ত্রী, ঘর সংসার, মা বোন সবকিছুকেই তুচ্ছ করে। প্রতিপক্ষ ভাবে সে। অবশ্য রেজিস্ট্রি বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই রেজার মাঝে কিছুটা অংলগ্ন আচরণ খেয়াল করে বৃষ্টি। বিষয়টাকে সে তখন এতটা গুরুত্ব দিতে চায়নি। অতিমাত্রায় রোমান্টিক, আবেগী বলে রেজা হয়তো এমন আওলাঝাওলা আচরণ করছে। বৃষ্টির ধারণা, মেধাবী মানুষদের আচরণ কিছুটা ক্ষ্যাপাটে, পাগলামোই হয়।
কিন্তু বাস্তবে বৃষ্টি এসে দেখলো মাদকের নেশা থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না রেজা। বৃষ্টির জীবনটাই শুরু হয় একজন মাদকাসক্ত স্বামীর সঙ্গে। জীবনের আনন্দঘন দিনগুলো অন্ধকার হয়ে আসে তার। মাদকাসক্ত স্বামী তার নিজের, স্ত্রীর ও পরিবারের কারও জন্য কোনো দায়দায়িত্ব অনুভব করে না। এ অবস্থায় চারদিক থেকে সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি চরম আস্থাহীনতা তৈরি হয়।
এর মাঝেই স্বস্তির পথ খোঁজে বৃষ্টি। কিন্তু কীভাবে? বৃষ্টি ভাবে এখানেই প্রত্যয়ী হতে হবে তাকে। রেজাকে পূর্বের প্রেমময় জায়গায় দেখতে চায় সে। আর সেজন্য তাকে শুরু করতে হবে নতুন যুদ্ধ। এ যুদ্ধটা তাকে একাই করতে হবে তা ভালো করেই জানে বৃষ্টি।
বৃষ্টি সিদ্ধান্ত নেয় রেজাকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। পূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু চিকিৎসাব্যয়ের জন্য কার দিকে চেয়ে থাকবে। দরকার অর্থের সংস্থান। সেজন্য চাই একটি চাকরি। হোক সেটা কম বেতনে। সিভি দিয়েই বৃষ্টি চাকরি পেয়ে গেলো ট্রান্সকম গ্রুপের ফুড বেভারেজে। ১৮ হাজার টাকা বেতন। ডিউটি ৭ ঘণ্টা।
বৃষ্টি চাকরি করুক তা কোনোভাবেই চায়নি শাশুড়ি জোবাইদা। তার বাধা উপেক্ষা করেই চাকরিতে যোগ দেয় বৃষ্টি। এবার অফিস, সংসারের কাজ সামলানোর পাশাপাশি রেজাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টায় সামিল হয় সে। তাকে বাসার কাছেই একটা মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে (রিহ্যাব) ভর্তি করায়। বৃষ্টির একাগ্রতা, সিরিয়াসনেস দেখে শ্বশুরবাড়ির লোকজন থমকে যায়। ইতিবাচক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বৃষ্টি তাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই পরিবারের জন্য সে এক মঙ্গালালোকের যাত্রী।
শুরু হয় বৃষ্টির ত্রিমুখী ডিউটি- অফিস, বাসার কাজের পাশাপাশি রিহ্যাব সেন্টারে গিয়ে রেজার ভালো-মন্দ খবর নেওয়া। এত যতœআত্তির পরও সেখানে বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসে রেজা। বৃষ্টি জেনেছে চিকিৎসা অপূর্ণ থাকলে ভালো হওয়া যায় না।
কিন্তু এখন কী করা! বাসাতেই তার কেয়ার নিতে শুরু করে বৃষ্টি। রেজা ঘুমে থাকতেই অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার চেষ্টা করে। ফিরে কখনো পায়, কখনো পাওয়া যায় না রেজাকে। যখন কাছে পায় তখন স্ট্র্যাটেজি চেঞ্জ করে নেয় বৃষ্টি। রেজাকে অভয় দেয়, বলে মাদককে আলাদাভাবে দেখার দরকার নেই। আর দশটা রোগের মতো মাদকাসক্তি একটা রোগ। বৃষ্টি বোঝাতে চায়, দেখাতে চায় মাদক গ্রহণকারী রেজা অপরাধী নয়, সে একটা অপরাধের শিকার। আর অপরাধ থেকে বাঁচতে স্বামীর প্রতি মমতা বাড়িয়ে দেয়, যতটা সময় পায় স্বামীর কেয়ারিংয়ে ব্যস্ত থাকে। ভালোবাসায় ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করে। স্বামীর অন্যায় আবদার ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে একমত পোষণ করে। তাকে বুঝতে, বোঝাতে চেষ্টা করে। এই পদ্ধতিতে রেজাকে কিছুটা ঘরমুখী করা সম্ভবও হয়। এর মাঝেই নিজের শরীরে পরিবর্তন টের পায় বৃষ্টি। এই প্রথম কনসিভ করলো সে।
কায়মনোবাক্যে তাই চেয়েছিল বৃষ্টি। ঘরে একজন অতিথির আগমন হলে মায়ার বাঁধনে আটকে যেতে পারে রেজা। সব ছেড়ে ঘরমুখী হতে পারে। তা হতে পারলেই এই যুদ্ধে বৃষ্টির জয় অবশ্যাম্ভাবী।
কিন্তু দুঃসংবাদটা আসতে সময় লাগেনি। ব্যাপক খাটুনি, টেনশনের ধকল সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে বৃষ্টি। হঠাৎ করেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জানলো বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে।
এই খবরে কষ্ট পেলেও আশাহত হয় না বৃষ্টি। আশায় বুক বাঁধে, নিশ্চয় নতুন কোনো ভালো সংবাদ সামনে অপেক্ষা করছে। বৃষ্টি সেই ভালো সংবাদের অপেক্ষায় ছুটটে নিরন্তর। কিন্তু মাঝপথে আবার বিপথগামী হয়ে পড়ে রেজা। পুরনো বন্ধুদের সাথে মিশে আবারও ঘরবিমুখ, জড়িয়ে পড়ে মাদকের নেশায়।
একবার মাদক সেবনরত অবস্থায় টঙ্গি থানার টহল পুলিশ ধরে নিয়ে যায় রেজাকে। খবর পেয়ে মধ্যরাতেই থানায় ছুটে যায় বৃষ্টি। হাজতখানায় গিয়ে মেঝেতে সুবোধ বালকের মতো শুয়ে আছে রেজা। বৃষ্টিকে দেখেই শিশুর মতো হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। যেভাবে পারো আমাকে তুমি এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। তোমাকে কথা দিচ্ছি এখান থেকে ছাড়িয়ে নিলে আর কখনো মাদক হাতে নেব না, বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকে রেজা।
রেজার কান্নায় বুক ফেটে যায় বৃষ্টির। এতকিছুর পরও রেজাকে অনেক ভালোবাসে সে। এখনো অনেক মায়া তার জন্য। তার শিশুতোষ আচরণ, বিনয় মাঝে মাঝে খুব দুর্বল করে তোলে তাকে।
যেভাবেই হোক থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে হবে রেজাকে। যে এসআই ধরে এনেছেন তার মুখোমুখি হতেই এমন ঝাড়ি দিলেন মনে হলো রেজা ৭ খুনের আসামী, ছাড়লেই তার চাকরি যাবে। ধরা-ছাড়ার বাণিজ্যটা জমিয়ে তুলতে পুলিশের এমন কৌশলের খবর আগে থেকে জানা আছে বৃষ্টির। তাই পুলিশের মারমুখী আচরণে ঘাবড়ে না গিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করে। সর্বশেষ ১০ হাজার টাকা হলে ছাড়া হবে-সাফ জানিয়ে দেয় এসআই ফারুক। কিন্তু বৃষ্টির কাছে এত টাকা নেই। শেষমেষ নিজের ব্যবহৃত ১২ হাজার টাকা দামের স্যামসাং সেটটি পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে নেয়ার দফারফা করে বৃষ্টি।
স্বামী আর কখনো মাদকে জড়াবে না, মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবে না, এরকম হলে ভবিষ্যতে আর ছাড়াতে আসবে না-এমন অঙ্গীকারপত্র লিখছে এসআই ফারুক নিজেই। লেখা শেষ হলেই তাতে স্বাক্ষর করবে বৃষ্টি। এসময় টেবিলে বসে এসআই-এর সঙ্গে আরও কিছু কথোপকথন হয় বৃষ্টির। সেই কথোপকথনের সূত্র ধরে এসআই ফিরে যান বৃষ্টির অতীতে, রেজার সঙ্গে যুদ্ধের দিনগুলোতে। শুনে মায়া হলো সেই পুলিশের। বললেন, আপনার মোবাইল সেট লাগবে না, এমনিতে নিয়ে যান।
এই যাত্রায় ছাড়া পেয়ে কিছুদিন ভালোই ছিল। বৃষ্টির কথার বাইরে কদম দেওয়ারও চিন্তা করেনি রেজা। বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে এমন আচরণ করে যেন সে একটা দুগ্ধপোষ্য শিশু। মায়ের কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশুর যেমন কদর, বৃষ্টির কাছেও রেজার কদর তেমনই। অতিমাত্রায় প্রশ্রয় বরং বৃষ্টিকে পদে পদে বিপদে ফেলেছে। যুদ্ধটাকে ক্রমশ দীর্ঘ করে তুলেছে।
প্রশ্রয় আর আদর পেয়ে রেজা উল্টোটাই হয়েছে। আবারও ঝুঁকে পড়লো মাদকে। মাদকের ফিন্যান্সার এবার বৃষ্টি নিজেই। রেজা এমনভাবে টাকা চাইত না দিয়ে পারতো না বৃষ্টি। টাকা দিতে দেরি হলে ব্যাগ খোলে নিজেই নিয়ে যেত। টাকা না পেলে ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলছে, ভাঙচুর করছে। ভয়ঙ্কর অবস্থা। বৃষ্টি না পারে ছুঁড়তে, না পারে ছাড়তে।
কোনো দোষ না করেই ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাসে জড়িয়ে গেছে বৃষ্টি। নিজে উপার্জন করে চলে, মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচার, স্বার্থপর শশুরবাড়ি, ছেলেমানুষ স্বামীর সমস্ত দায়দায়িত্ব বহন করেও দুদুণ্ড শান্তি মিলে না।
শান্তি, স্বস্তি বলতে যা বোঝায় সেটা বোধহয় এই জীবনে আর হবেই না। বৃষ্টিকে নিয়ে কবিরাজ জসিমের কাহিনীটি এতদিন পর কীভাবে যেন জেনে গেছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ নিয়ে শাশুড়ির তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাষাগুলো মাঝে মাঝে বুলেটের চেয়েও কঠিন হয়ে বিদ্ধ হয় বৃষ্টির বুকে। দুগ্ধশিশুর মতো আচরণ করে যে স্বামী, যার জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গিত সেও কিনা নতুন করে জেগে উঠলো। পাঁচ আঙুল দিয়ে ভাতটাও ঠিকমত যে খেতে জানে না সেই রেজাই কবিরাজ ইস্যুতে বৃষ্টিকে কঠিন কথা বলছে, ছোট ছোট অনুভূতিগুলোকে ছিড়ে চ্যাপ্টা করছে।
এই ঘরে আর নয়, দৃপ্ত শপথে যে যুদ্ধটা শুরু করেছিল সে যুদ্ধটা বরং দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে, হাঁটছে গতিহীন পথে- বেশ বুঝতে পারে বৃষ্টি।
কিন্তু স্বামীর জন্য যে প্রবল মায়া তার! সেই মায়ার জাল এবার ছিন্ন করতে হবে। স্বামীকে দেখার জন্য তার পরিবার আছে। বৃষ্টির কেউ নেই। বুঝে হোক না বুঝে হোক জন্মদাতা বাবা-মা যখন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে যায় তার আর কেউ থাকার কথাও নয়। তাছাড়া ছাইভস্ম সতীত্বের পাশে কেউ না থাকাটাই স্বাভাবিক।
বৃষ্টি মাদকাসক্ত নয়, একজন স্বাভাবিক মানুষ। তার কিছু শারীরিক মানসিক চাহিদা আছে। কিছু ইচ্ছা আর কিছু স্বপ্ন আছে। আছে মা হবার আকাক্সক্ষা। সে কেন সব বিসর্জন দিয়ে এভাবে বেঁচে থাকবে?
বৃষ্টি নিজেকে প্রশ্ন করে যার জন্য তার এত ছাড় সে কি সত্যিই তাকে ভালোবাসে? আজকেই প্রথম এ নিয়ে তার মাঝে সংশয় তৈরি হলো। বৃষ্টির প্রশ্ন- ভালবাসলে নিজের জন্য না হলেও বৃষ্টির জন্যে সে নিজেকে পাল্টে ফেলতো। বৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরে আছে রেজা, কারণ বৃষ্টি তার উপার্জনের উৎস। এটাকে ভালোবাসা ভেবে আর ভুল করতে চায় না বৃষ্টি।
যতক্ষণ অন্য কারো স্ত্রী, ততক্ষণ কেউ আর সাহস করে তার হাত ধরতে চাইবে না। তাই বৃষ্টির মনে হয়, নিজেকে মুক্ত করে নেয়াই ভালো হবে। আর কিছু না হোক, অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।
বুকে পাথর বেঁধে হলেও ডিভোর্সটা এবার দিতে হবে। শেষমেশ তাই করলো বৃষ্টি। ৪ বছরের অসম, অপরিণত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটালো দুই পৃষ্ঠার নোটিশের মাধ্যমে। কাছের দূরত্বের এই চাকরিতে থাকলে আবারও জীবনের ফ্লাশব্যাক হতে পারে, ফের কুৎসিত অতীতে জড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তাই চাকরিটাও ছেড়ে দিলো।
জীবন আর জীবিকার দুই চাকরি থেকে একইসঙ্গে ইস্তফা নিয়ে বৃষ্টি ছুটে চললো অজানার উদ্দেশ্যে। ঘুরতে ঘুরতে ঠিকানা হলো চট্টগ্রাম। নগরীর বন্দরটিলা এলাকায় এক ফুফুর বাসায় সাময়িক থাকার জায়গা করে চাকরির সন্ধানে ছুটলো বৃষ্টি। চাকরিভাগ্য ভালো বৃষ্টির। একমাসের মধ্যে প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেলো জুনিয়র অফিসার পদে। ব্যাংকিং সেক্টরের চাকরিতে বেতন মন্দ নয়। থাকা-খাওয়া ও নিজের খরচের পর আরও কিছু টাকা অবশিষ্ট থেকে যায় বৃষ্টির, মা-বাবার কাছেও মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠায়।
একটা গৎবাঁধা, রুটিনমাফিক নতুন জীবন বৃষ্টির। বাড়তি কোনো চাপ নেই, নেই সারাক্ষণ যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি। সেই অর্থে আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে বৃষ্টি। কিন্তু এই জীবনে কোনো চার্ম নেই, অ্যাডভাঞ্চার নেই, নেই প্রেম-রোমাঞ্চ। এই একঘেঁয়ে জীবন বৃষ্টির মতো ছটফটে, গণমুখী মেয়ের জন্য না। ছোটবেলা থেকে বৃষ্টির স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। অন্য ১০ নারীর চেয়ে ব্যতিক্রম হবে, দেশের জন্য কাজ করবে, দেশবরেণ্য হবে।
কিন্তু একজন ভণ্ড কবিরাজের কারণে সে আজ ‘জীবন এক্সপ্রেস’র লাইনচ্যুত যাত্রী। জীবনের ছন্দপতনটা শুরু হয়েছিল তো তখনই, কবিরাজ জসিমের হাতে। যার ক্ষত, রক্তক্ষরণ এখনো বয়ে বেড়াতে হয় তাকে। রেজার সঙ্গে যুক্ত হওয়া, তারপর অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা- সবই তো কবিরাজের বিকৃত যৌন হিং¯্রতায় পোড়া, বিধ্বস্ত সতীত্বেরই ইজা। এর মাঝেই কী প্রেম, কী রোমাঞ্চ! কীসের জীবন! কর্ম করে দুবেলা খেতে পারছে, বেঁচে আছে এটাই তো যথেষ্ট। পোড়া সতীত্বের জীবন নিয়ে এমন থাকারও কি কথা ছিল! সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতার হাত তুলে বৃষ্টি।
ব্যাংকের চাকরি, খাওয়া-দাওয়া ও লম্বা বিশ্রামে জীবন চলে যাচ্ছে বৃষ্টির। এর মাঝেই ব্যাংকের এক সহকর্মীর দুর্বলতা আঁচ করে বৃষ্টি। বৃষ্টি ভেবেছিল জীবনে আর কোনো কঠিন সম্পর্কে জড়াবে না, বড়জোড় কারো সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ হতে পারে। কলিগের দায়িত্বশীল আচরণ, ভালোলাগার হাতছানি, বাড়তি কেয়ারিং বৃষ্টিকে উদ্বুদ্ধ করে, ভাবিয়ে তোলে। ভদ্র, মার্জিত, কথাবার্তায়ও শালীনতা আছে লোকটার। ক্ষতি কী, একটা বন্ধুত্ব যদি গড়ে উঠে।
সহকর্মী রায়হানের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে বৃষ্টির। রায়হানের বন্ধুত্বপূর্ণ সঙ্গটা মন্দ নয়, সময় পেলে দুজন আড্ডা দেয়, রেস্টুরেন্টে বসে এটা-ওটা খায়, ভালো কিছু সময় একসঙ্গে কাটায় তারা। কিন্তু এর মাঝেও বৃষ্টির ভয়, শঙ্কা। সঙ্গ দিতে এবং নিতে গিয়ে যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়! বাড়তি কিছু চেয়ে বসে রায়হান! হ্যাঁ, শঙ্কাটাই সত্য হলো। এক পর্যায়ে বৃষ্টির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে মরিয়া রায়হান। কিন্তু কীভাবে সম্ভব। বৃষ্টি তো ¯্রফে সঙ্গ চেয়েছিল, ভালো বন্ধুর সঙ্গ, ভালো মানুষের সঙ্গ। কিছুদিন যেতে না যেতে বৃষ্টি বুঝতে পারলো শুধু দেহ নয়, তার অর্থের প্রতিও লোলুপ দৃষ্টি রায়হানের।
লোভী, বিকৃত রুচির মানুষটি থেকে নিজেকে রক্ষার পথ খোঁজে বৃষ্টি। কিন্তু সেই পথটা সহজও নয়। রায়হানই কন্টকাকীর্ণ করে তোলে। বৃষ্টি যেই সম্পর্ক রাখবে না বলে জানিয়ে দেয় তখনই নোংরা হয়ে উঠে রায়হান। অফিসে কলিগদের কাছে বৃষ্টিকে নিয়ে ছড়িয়ে দেয় নানা গালগল্প, উড়িয়ে দেয় কল্পকথার ফানুস। বৃষ্টির সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে, একান্তে পাশাপাশি কোনো একসময় তোলা ক্লোজআপ ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় রায়হান।
প্রতিনিয়ত এধরনের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে যে মানুষ তার সঙ্গে রোজ দেখা হয় বৃষ্টির। অফিসে একেবারে মুখোমুখি তাদের চেয়ার। তার চোখোচুখি, মুখোমুখি হলেই বৃষ্টির মাজে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা তৈরি হয়। এই রূদ্ধশ্বাস অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় বৃষ্টি। ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করে অন্য শাখায় ট্রান্সফারের সুযোগ নিয়ে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারতো। কিন্তু তা না করে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের হাতে রিজাইন লেটারটা ধরিয়ে দেয় বৃষ্টি।
চাকরিটা ছেড়ে দিলেও কয়েকমাস চলার মতো টাকা আছে বৃষ্টির। আপাতত থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই তার। চিন্তাটা অন্য জায়গায়। এ কেমন জীবন। এই জীবনে স্বস্তি, শান্তি, স্থিরতা আদৌ আসবে?
অবশ্য স্থিরতার চিন্তা সে বাদ দিয়েছে। কবিরাজ জসিমই তার জীবনকে স্থায়ীভাবে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে বহু আগেই। এটা তার এক্সটেনশন লাইফ। এসব ভাবতে ভাবতে রেজার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। কোথায় আছে, কেমন আছে রেজা। মাদক কি ছাড়তে পেরেছে? আচ্ছা এমন হয় কেন। যে মানুষটার জন্য চারটা বছর শরীর অঙ্গার করেছে, ছাই করেছে জীবনের সবকিছু সে মানুষটাকেই কেন এত মনে পড়ে তার। কেনই বা এত টান তার জন্য।
ইচ্ছা হলো রেজার খোঁজ নিতে। কিন্তু কীভাবে। রেজার সেই পুরনো রবি নাম্বারটি এখন আর ব্যবহার হয় না। বৃষ্টি সিদ্ধান্ত নিলো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলবে। তাতেই খুঁজবে রেজাকে। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে জীবনের প্রথম ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুললো বৃষ্টি। খুলেই সার্চ দিয়ে খুঁজে পেলো রেজাকে। তার ইনবক্সে লিখে পাঠালো দীর্ঘ এক চিঠি।
রেজা,
কেমন আছ জানতে চাই না। শুধু জানতে চাই তুমি কি দেখতে পাও তোমার কথা ভেবে আমার বুকের ভেতর বয়ে চলা কষ্টের নীল স্র্রোতধারা। এখনো তোমার কথা ভেবে আমার দিন শুরু হয় আর শেষ হয় তোমার কথা ভেবে। আর দিনের হিসাব করছি কেন? আমার কাছে তো দিন নেই, নেই রাত। এখানে সময় নেই, সীমা নেই, আছে শুধু অসীমের মাঝে ছুটে চলা। সেই অসীমের দৃষ্টিসীমায় আমার চোখের দৃষ্টির মাঝে জেগে থাকো তুমি। তোমাকে হারিয়ে আমি যখন নীল চোখকে ভেজা স্যাতস্যাতে করে অশ্রুবর্ষণ করি সে বর্ষণ মিশে যায় শরতের নীল আকাশের দুপশলা মৃদু বৃষ্টিতে।
যখন তোমার বিরহে আমি মুখ কালো করে নির্জন নিস্তব্ধ রাতে বসে থাকি একা একা তখন মনে হয় তুমি রাতের কালো আকাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছ নিষ্পলক দৃষ্টিতে। আমার নীল চোখের তারা রাতের আকাশের তারাদের সাথে মিশে গিয়ে তোমাকে খুঁজে। কিন্তু তুমিই বলো রাতের আকাশের তারারা কি খুঁজে পায় আকাশকে যার মাঝে তার বসবাস?
তাই তো আমি তোমাকে খুঁজে পাই না। অথচ আমার হৃদয় তো বাস করে তোমার মাঝেই। আমি যখন কোনো এক বিষণœ অপরাহ্নে তোমার স্পর্শ অনুভবের ব্যাকুলতা নিয়ে তোমার পরশ পাবার চিন্তায় আমার ব্যালকনিতে বসে থাকি তুমি তখন মৃদু হাওয়া হয়ে আমাকে ছুঁয়ে যাও। চলে যাই দূরে আবার তোমার পরশ পেতে ছুটে আসি।
সত্যি করে বল, তুমি কি পাওনা আমার হৃদয়ের ছোয়া? তোমার কষ্ট আনন্দে সবসময়ই তোমার সাথে ছিলাম, আছি। তুমি কি আমাকে খুঁজে পাওনা; কোনো পঞ্চমীর রাতে যখন আমি তোমার ভালবাসার ছোঁয়ায় ব্যাকুল হয়ে খুশিতে মনটাকে ভিজিয়ে তুলি তখন তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাস বাকা চাঁদটার মাঝে হারিয়ে গিয়ে। আর কোনো গোধূলিতে
যখন তুমি তোমার মনের তুলিতে সযত্নে বারে বারে সাজাও আমার মুখচ্ছবি তখন আমি গোধূলি সূর্যের মত রাঙা লাল হয়ে যাই লজ্জায়।
আর তোমার বিষণ্নতাভরা দুপুরে আমি তোমার পাশে বসে থাকি তোমার চারদিককার ভয়াবহ নির্জনতা হয়ে। দুই ভুবনের বাসিন্দা হয়েও তো আমরা আলাদা হয়ে যাইনি, যাব না। মরণে জীবনে মিশে থাকব একে অন্যের মাঝে।
তোমারই
বৃষ্টি
চিঠিখানা ফেসবুকে ইনবক্স করার তিনদিনের মাথায় রিপ্লাই আসে রেজার। কই তুমি, কেমন আছ? একেবারে সাদামাটা দুটো বাক্য লিখে বৃষ্টির সেল ফোনের নাম্বারটা ইনবক্স করতে বলে। সাথে সাথে তাই করলো বৃষ্টি।
সেদিনই রাত ১২টায় বৃষ্টির ফোন বেজে ওঠে। ঘুম ভেঙে ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ভেসে আসে রেজার ভরাট কণ্ঠ। কী করছো, রাতের খাবার সেরেছো? ৪ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর যখন কথা হয় স্বাভাবিকভাবেই সেই কথাই উচ্ছ্বাস থাকে, আবেগ থাকে। কিন্তু সেধরনের কিছু নেই রেজার কণ্ঠে। কিন্তু প্রতিটি কথায় একটু কেয়ারিং, দায়িত্ববোধের চিহ্ন। রেজার অ্যাপ্রোচ আর প্রেজেন্টেশনে মনে হলো তাদের মাঝে কিছুই হয়নি, কোনো ভুল বোঝাবুঝি কিংবা দুরত্বের লেশমাত্র নেই। বরং স্ত্রীর প্রতি একজন দায়িত্বশীল স্বামীর পারফ্যাক্ট আচরণ ফুটে উঠে একঘণ্টার টেলিফোন আলাপে।
রেজার আহ্বানে পরদিনই তুর্না-নিশিতায় ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছাড়ে বৃষ্টি। স্টেশনে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে রেজা। নতুন করে ধরলো বৃষ্টির হাত। সেই ধরাতেই কমলাপুর স্টেশনসংলগ্ন একটি আবাসিক হোটেলে উঠলো তারা। বৃষ্টির জন্য বিশাল সুখবর। রেজা মাদক ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষ। ৭ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরি করছে কিছুদিন ধরে। কথাবার্তায়, ব্যক্তিত্বে আগের অর্থাৎ প্রেমময় জীবনের যে রেজা সে রেজারই প্রতিচ্ছবি আজকের রেজার মধ্যে।
বৃষ্টি-রেজা হাতে হাত রেখে নতুন করে শপথ নিলো মৃত্যুপর্যন্ত তারা একসাথে থাকবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের আর দ্বিখণ্ডিত করতে পারবে না। কিন্তু তারা তো ডিভোর্সি। বহু আগেই একবুক কষ্ট নিয়ে অশ্রু দিয়ে বৃষ্টির লেখা তালাকনামাটি এরমধ্যেই কার্যকর হয়ে গেছে। তাদের একসাথে চলার পথে ধর্মীয় বাধা ছাড়া আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
অনেক ঝড়-তুফানের পর দুটি প্রাণ দুটি মন এক হওয়া মানে পুণ্যের কাজ, পবিত্রতম
বিষয়। আমরা খুশি হলে বিধাতাও নিশ্চয় খুশি হবেন। মানুষের প্রেমময় মিলনে, পবিত্রতম সম্পর্ক, ভালোবাসায় তিনিই তো সবচেয়ে বেশি খুশি হন। আমরা ভালো থাকলে, ভালো চললে তিনি নিশ্চিত খুশি হবেন, আমাদের এগিয়ে দেবেন। এই বিশ্বাস রেজার। রেজার বিশ্বাসের সঙ্গে একমত পোষণ করে বৃষ্টিও।
সেই বিশ্বাস আর ভরসা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন শুরু করলো তারা খিলগাঁ রেললাইনের কাছে দুকামরার একটি বাসায়। অফিসে আসা-যাওয়ার পথেই খরচ হয়ে যায় রেজার বেতনের ৭ হাজার টাকা। বাসা ভাড়াসহ দুজন মানুষ চলতে অন্তত ৩০ হাজার টাকা দরকার। বৃষ্টির কাছে সঞ্চয় যা আছে তাতে দুইমাস চলবে। তারপর কী হবে!
তার আগেই যেভাবে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে বৃষ্টিকে। বৃষ্টির আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। জীবনের জলখেলি আর রঙ মাখামাখিতে কাটছে তার সময়গুলো। রেজা পাশে থাকলে বৃষ্টির পক্ষে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। রেজার রোজগার না হলেও কোনো সমস্যা নেই। বৃষ্টিই চালিয়ে নিয়ে যাবে রেজাকে। বৃষ্টি বোঝে হৃদয়ে প্রেম থাকলে, মনে সুখ থাকলে জীবনে কোনো কিছুই দুর্ভেধ্য হতে পারে না।
কিছুদিন পর পুরনো কর্মস্থল ট্রান্সকম গ্রুপের ফুড বেভারেজে যোগাযোগ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরির নিয়োগপত্র পেয়ে যায় বৃষ্টি। কাজের প্রতি একাগ্রতা, সততা, দায়িত্বশীলতার কারণে আগেই একটা গ্রহণযোগ্যতা কর্মস্থলে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল বৃষ্টি। হুট করে চাকরিটা ছাড়ার পরও কর্তৃপক্ষ অনেক ফিল করেছে বৃষ্টিকে। সেই ভাবমূর্তিটাই বৃষ্টির মূলধন। তাই যোগাযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) বললেন এখনই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে যান। কাল জয়েন করুন।
বৃষ্টির বেতন ৩০ হাজার, রেজার ৭ হাজার। এ নিয়ে বিব্রতবোধ করতো রেজা। মনটা ছোট হয়ে থাকে সবসময়। ধুর বোকা! ৭ হাজার টাকা নয়, তোমার যদি এক টাকাও উপার্জন না থাকে তবুও তুমি আমার কাছে পরম আরাধ্যজন, সেরা মানুষ। বৃষ্টির এই কথার পরও অস্বস্তিতে ভোগে রেজা। ব্যক্তিত্বজনিত সঙ্কট থেকে মুক্তি পায় না সে।
একদিন অফিসে কাজের ফাঁকে জিএম হিন্দু ভদ্রলোকের সাথে এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলে বৃষ্টি। শুনে হৃদয়বান জিএম বললেন সিভিটা নিয়ে আসুন, দেখি কী করা যায়। পরদিন ইন্টারমিডিয়েট পাশ স্বামীকে বিবিএ উত্তীর্ণ দেখিয়ে সিভি সাবমিট করে বৃষ্টি। বৃষ্টি নিজেই রেজার সিভি প্রস্তুত করে।
বৃষ্টির স্বামী বলে কথা। তাই সার্টিফিকেট প্রদর্শন ছাড়াই পরের মাসের এক তারিখ থেকে ট্রান্সকমের অন্য এক বিভাগে অফিসিয়াল চাকরি কনফার্ম হয়ে যায় রেজার। বেতন ধরা হয় ২৫ হাজার টাকা। দুজনে মিলে মাসে বেতন তোলে ৫৫ হাজার টাকা।
তাদের আর অর্থসঙ্কট থাকলো না। সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগা রেজা এখন ব্যক্তিত্ববান, দামী স্বামীর একজন। স্ত্রীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সবমিলিয়ে সুখী গৃহকোণ তাদের। বলা চলে উপচে পড়া সুখ। আহা, এমন সময়ের জন্য কত অপেক্ষা, কত যুদ্ধ বৃষ্টির। অন্ধকার ভেদ করে উৎসারিত আলোয় তারা আজ পূর্ণাঙ্গ সুখী দম্পতি।
কিন্তু তাদের এই সুখ মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। সুদর্শন রেজার জীবনে, মনে নতুন রেখাপাত তৈরি করে অকস্মাৎ হাজির হয় অনন্যা নামের অফিসেরই এক কলিগ। সহকর্মীসুলভ সখ্যতা থেকে একসময় প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরে রেজা-অনন্যা। অফিস শেষ করে কফি সপের আলো আধারিতে চুটিয়ে আড্ডা শেষে রেজা যখন বাসায় ফিরতো তখনও মাঝে মাঝে অনন্যার ফোন বেজে উঠতো। বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলী রেজা ফোন ধরেই সুর পাল্টিয়ে ফেলতো। কলিগসুলভ আচরণ করেই কথা শেষ করতো। কখনো কখনো বৃষ্টিকে ফোন ধরিয়ে দিতো। আন্তরিকভাবে উইশ করতো বৃষ্টি। ফলে বৃষ্টি কোনোভাবেই বুঝতে পারতো না রেজা-অনন্যার মাঝে অন্য সম্পর্কের বিষয়টা। বরং একটা সরলরৈখিক সম্পর্কের সমীকরণ করে অনন্যার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে রেজাকে অনুপ্রাণিত করে বৃষ্টি।
কিন্তু না, যত দিন যায় ততই বেপরোয়া হয়ে পড়ে অনন্যা রেজার সম্পর্কটা। তাদের ডেসপারেট চলাফেরা, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে ঘুরে বেড়ানোর খবর অফিসে আর গোপন রইল না। একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এই খবর বৃষ্টির কানে পৌঁছুতেও সময় লাগেনি। বৃষ্টি যখন
বিষয়টি নিয়ে জানতে চায়, প্রশ্ন করে বেমালুম অস্বীকার করে রেজা। উল্টো ঝারি দেয়, বলে তোমার মাথা ঠিক আছে তো! অফিসের কিছু কলিগ ইর্ষান্বিত হয়ে অনন্যার সাথে তার পবিত্রতম, সুন্দর সম্পর্কটাকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এতে তুমি কান দিও না। রেজাতেই আস্থা রাখে, বিশ্বাস স্থাপন করে। রেজার কথাকেই চিরসত্য বলে ধরে নেয় বৃষ্টি।
কদিন যেতে না যেতেই বজ্রপাতের মতো এসে হাজির হয় দুঃসংবাদটি। রেজার সঙ্গে শারীরিক মেলামেশায় গর্ভবতী হয়ে পড়ে অনন্যা। ইউরিন ফর প্র্যাগনেন্সি টেস্টের পজিটিভ রিপোর্টটা অফিসে নিজের টেবিলে ভুলক্রমে রেখে যায় অনন্যা। আর সেটিই চাওর হয়ে যায় একান ওকান করে অফিসের সব কানে। কলিগরা ভাবে, অনন্যা অবিবাহিত। কাজেই প্র্যাগনেন্সি টেস্টের বিষয় কেন। পরদিন কলিগদের কানাঘুষা, টিপ্পনি কাটায় নিজের দৃঢ় চরিত্র জাহির করতে গিয়ে অনন্যাই অকপটে জানিয়ে দেয় রেজাকে সে বিয়ে করেছে। কাজেই সে প্র্যাগনেন্ট হতেই পারে। এটা তার বৈধ প্র্যাগনেন্সি।
অথচ বাস্তবে রেজার সঙ্গে তার তখনও বিয়ে হয়নি। অনন্যার গর্ভের সন্তান তার অবৈধ মেলামেশারই ফল। রেজার এই স্বীকারোক্তি এরিমধ্যে জেনে গেছে অফিসে রেজার ঘনিষ্ঠ কলিগরা।
এই খবরে বৃষ্টির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সেও কনসিভ করেছে এরমধ্যে। অনেক আরাধনা, স্বপ্নের ফসল তার গর্ভের সন্তান। কী করবে, কোথায় যাবে সে তার অনাগত সন্তান নিয়ে। এ নিয়ে মুখোমুখি হতেই রূদ্রমূর্তি ধারণ করে রেজা। জানে সে এখন অস্বীকার করলেও কোনো লাভ হবে না। তাই সে ভদ্রতার আবেশে লুকিয়ে থাকা চূড়ান্ত, ভয়ঙ্কর মুখোশটাই খুলে ফেলে বৃষ্টির সামনে। মানসিকভাবে আঘাত করে নির্মম, নিষ্ঠুর বাক্য ছুঁড়ে।
হ্যাঁ, তুমি যা শুনেছে সব সত্যি। অনন্যাকে আমি বিয়ে করেছি। তার গর্ভের সন্তান আমার সন্তান, বৈধ সন্তান। পারিবারিক আয়োজনে র্যাপড হওয়া, আনুষ্ঠানিকভাবে সতীত্ব বিকিয়ে দেওয়া কোনো নারীর সঙ্গে মানসিকভাবে আমি অন্তত থাকতে পারি না। আমি আর পারছিলাম না। তাই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।
রেজার এই বৈপরীত্যে হতবাক বৃষ্টি। মুখের উপর এতটা কঠিন করে কেউ বলতে পারে বৃষ্টির কল্পনাতেও ছিলো না। তার পায়ের তলা থেকে যেন ক্রমশ মাটি সরে যাচ্ছে। রেজাকে পাল্টা কোনো জবাব না দিয়ে একটা কথাই শুধু শুনিয়ে দেয়, বৃষ্টি। হ্যাঁ, সব দায় আমার। এমন অচ্ছুৎ, কলংকিনী নারীকে তুমি এতদিন সহ্য করেছে এটাই বেশি। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম আজীবন। আমার তো এও পাওয়ার কথা ছিল না। খুব কষ্ট করে রাতটা কাটানোর পর একটা লাগেজ নিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো বৃষ্টি। অফিসে গিয়ে রিজাইন লেটার লিখলো, তারপর জিএম-এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অফিসে থেকে বেরিয়ে গেলো। একই অফিসে, একই মানুষের সামনে স্বামীর এমন কা-কীর্তন নিয়ে এক মুহূর্তও অবস্থান করা বৃষ্টির জন্য কঠিন।
যশোরের নিবারণের দিকেই বৃষ্টির গন্তব্য। যেতে যেতে ভাবছে জীবনটা এমন হলো কেন! জীবনের শুরুতে বড় হোঁচটটা খাওয়ার পরও তপ্ত জীবনটাকে কিছুটা হলেও সহজ করা যেতো। কিন্তু বেশি মানবিক হওয়া, বেশি বোঝাটাই বরং তার জন্য কাল হলো। বোঝাটাই যেন বড় ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়ালো।
গর্ভের অনাগত সন্তানই তার এখন বেঁচে থাকার প্রেরণা। এই সন্তান নিয়ে জীবনের সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সুখ-দুঃখের সূত্র মেলাতে চায় বৃষ্টি। এজন্য গর্ভের সন্তানকে ৪ মাস ধরে সযত্নে লালন করে। কিন্তু এখানেও পোড়াকপাল তার। পোড়া ভাগ্য, পোড়া সতীত্ব তার পিছু ছাড়ছে না।
এক সন্ধ্যায় বাথরুমে যাওয়ার পর লক্ষ করে আচমকা তার ব্লাড যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পাশের হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হাসপাতালের ডাক্তারদের গলদগর্ম হতে হয়। ডাক্তারদের প্রাণান্তকর চেষ্টায় বৃষ্টির রক্তক্ষরণ বন্ধ হলো গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার মধ্যদিয়ে।
রেজা অনন্যাকে বিয়ে করে বাচ্চার স্বীকৃতি দিলো। সংসার পাতলো নতুন করে। একজনের ঘর ভাঙার জন্য অনন্যার চাকরি গেলো, কিন্তু রেজার কিছুই হলো না। বৃষ্টি ইচ্ছা করলে শিক্ষাগত যোগত্যার তথ্য গোপন করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে রেজার চাকরিটা খোয়াতে পারে। কিন্তু তা সে করবে না। কারণ সে-ই তো এই তথ্য গোপন করে জিএম-এর কাছে দেয়া বায়োডাটায় রেজাকে বিবিএ উত্তীর্ণ দেখিয়েছিল। কী করে সে জানাবে এই কথা। এতে সে নিজেই ছোট হবে।
তাছাড়া রেজাকে চাকরিচ্যুত করে বেকায়দায় ফেলতে রাজি নয় বৃষ্টি। হাজার হলেও এই রেজার কারণেই ক্ষনিকের সুখের দেখা পেয়েছিল, স্ত্রী হতে পেরেছিল। এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে সে সবকিছু চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাই কাউকে নয়, নিজেকেই অভিশম্পাত দেয়, ধিক্কার দেয় বৃষ্টি।
বৃষ্টি বুঝে নিল ভণ্ড কবিরাজ যে কলঙ্কতিলক এঁকে দিয়েছে সে কলঙ্কের গ্লানি আজীবন তাকে টানতে হবে।
[দ্রষ্টব্য : গল্পটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত। এখানে কেবল চরিত্রগুলোর নাম পরিবর্তন হয়েছে।]