আবছার রাফি : বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ড চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ঘটলেও এতে যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে কাছের দুটি ফায়ার স্টেশন। গত ৪ জুন রাত নয়টার দিকে ডিপোতে যখন অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় তখন সে আগুন নেভাতে একদম শুরুতে গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ড এবং কুমিরা ফায়ার স্টেশনের দমকল কর্মীরা। সেদিনের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ১০ জন দমকল কর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিপো থেকে উদ্ধার করা যেসব পোড়া লাশ শনাক্ত করা যায়নি, তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের আরও তিনজন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, আহত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন চিকিৎসাধীন আছেন। মৃত, নিখোঁজ এবং গুরুতর আহত সবাই সীতাকুণ্ড এবং কুমিরা ফায়ার স্টেশনের কর্মী।
সংস্থাটির সিনিয়র স্টাফ অফিসার এবং মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. শাহজাহান শিকদার জানিয়েছেন, ১৯৮১ সালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পূর্ণগঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭ জন দমকল কর্মী মারা গেছেন। বাংলাদেশে একসাথে এতজন দমকল কর্মীর প্রাণহানি আর কখনোই ঘটেনি।
ফায়ারকর্মীদের আন্তরিকতা, সাহস এবং মানবিক তৎপরতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে হলেও জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সংস্থাটির দুর্বলতা তাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই জনবল ও সরঞ্জাম সংকটে আছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় অধিদপ্তরকে। আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকে ডেকে আনতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটকে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, বিএম ডিপোর আগুন নেভাতে ঢাকা থেকে আনা হয়েছে হাজমত টেন্ডার (গাড়ি), এই ধরনের বিশেষায়িত গাড়ি চট্টগ্রামে নেই। যথাযথ সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ ঘাটতির কারণে খুব কাছে গিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে সীতাকুণ্ডে হতাহত হয়েছেন ফায়ারকর্মীরা।
সূত্র জানায়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে সম্প্রতি জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিন, রিমোট কনট্রোল ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, টোয়িং ভেহিক্যাল, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস ও স্মোক ইজেক্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
এর আগের বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে, বস্তিতে, রাসায়নিক গুদাম ও মার্কেটে লাগা আগুনে ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘটছে হতাহতের ঘটনাও। গত সাত বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি বছরই অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২১৮ কোটি ৩১ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। নিহত হয়েছেন ২১৯ জন। ২০২০ সালে দেশে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৭৩টি। এতে ১৫৪ জন মারা গেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০১৯ সালে সর্বাধিক ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। ২০১৮ সালে হয়েছে ১৯৬৪২, ২০১৭ সালে হয়েছে ১৮ হাজার ১০৫, ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৮৫৮ ও ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে।
যদিও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে বড় সমস্যা অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অগ্নিনির্বাপক সনদ ছাড়াই ভবন নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় জলাধার না থাকা। কিন্তু আধুনিক সরঞ্জাম ও জনবল সংকটেই বিলম্ব হয় তাদের। বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগার পর সংস্থাটি তা নেভানোর চেষ্টা করলেও বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে না যাওয়া, নেভানোর সময় পানি শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যাও। কিন্তু সেই অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের জনবল বাড়েনি। ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ৩০ হাজার জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন ফায়ার কর্মকর্তারা। সারা দেশে ফায়ার স্টেশন আছে ৪৮৯টি। কিন্তু সেই হারে বাড়েনি জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের জনবল আছে ৯ হাজার ৭১৭ জন। যার মধ্যে ফায়ারম্যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম আছে ৪ হাজার ৩৯৪টি। তার মধ্যে রেসকিউ কমান্ড কার আছে মাত্র ৩টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার সার্ভিসের জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি সদস্যদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। শুধু সচেতনতা, পরামর্শ ও সুপারিশ দিয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া সবাইকে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক, তেজস্ক্রিয় দ্রব্য গুদামজাত করা বন্ধ করতে হবে। আইনকানুন, নিয়মনীতি, ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে হবে। উঁচু ভবন করার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়মিত ব্যবহারকারীদের সচেতন এবং প্রস্তুত করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিভাগে ফায়ার স্টেশন আছে ১১০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৬টি, রাজশাহী বিভাগে ৬৬টি, খুলনা বিভাগে ৫৬টি, বরিশাল বিভাগে ৪১টি, সিলেট বিভাগে ২৯টি, রংপুর বিভাগে ৫৯টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২টি আছে।
এই প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, যেভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তাতে আমরা অনেকটা আতঙ্কিত। কারণ ফায়ার সার্ভিসে প্রয়োজনের তুলনায় সরঞ্জাম অনেক কম। প্রত্যেক সদস্যকে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে হলেও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নতমানের প্রশিক্ষণ থাকলে সীতাকুন্ডে ৯ সহকর্মীকে হারাতে হতো না।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যেকোনও স্থাপনা ও ভবন নির্মাণ করতে গেলে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই নিজস্ব ফায়ার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। আর বহুতল ভবনগুলোর ক্ষেত্রে তো অবশ্যই আগুন নির্বাপণের সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে অন্তত ১৫ থেকে ২০ মিনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। সাধারণত ফায়ার সার্ভিসের রেসপন্সটা হলো ১৫ থেকে ২০ মিনিট। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে চলে আসবে। তারা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করবে। সেই সময়টা তো আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোড রয়েছে। কতোটুকু জায়গায় কয়তলা ভবন হবে, ফায়ার সিকিউরিটি কী হবে– সবই বলা আছে ভবন নির্মাণ নীতিমালায়। ভবন নির্মাণের নীতিমালায় সব বলে দিয়েছে সরকার। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। এই নীতিমালাটা আমাদের মানতে হবে। মানার মানসিকতা থাকতে হবে। আইন মানার অভ্যাসটা নিজ থেকেই করতে হবে। তাহলেই আমরা নিরাপদ থাকতে পারবো।’
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার এবং মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের সমস্যা নিরসনে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগই চলমান অবস্থায় রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে দেশে ফায়ার স্টেশনের মোট সংখ্যা হবে ৭০০-এর বেশি। অধিদফতরের নতুন কাঠামোতে ২৫ হাজারের বেশি জনবল কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে তেমন সংকট থাকবে না। পাশাপাশি মুন্সীগঞ্জে ১০০ একর জমির ওপর ফায়ার একাডেমি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেন, লোকবলসহ অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে ফায়ার সার্ভিস সমস্যায় আছে তা সত্য। তারপরও তারা নানাভাবে চেষ্টা চালায়। এই ক্ষেত্রে সরকারও বেশ আন্তরিক। আশা করি ফায়ার সার্ভিসে উন্নতমানের সরঞ্জামের পাশাপাশি জনবল বাড়ানো ও সদস্যদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।