:: নূর মোহাম্মদ (নূর) ::
বিশ্বের গুটিকয়েক সৌভাগ্যবান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি, যার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ যুবক। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর ২০১৪ সালের রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে ১৫৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠির মধ্যে ৪৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন বা ৩০ শতাংশ যুবক, যাদের বয়সরেখা ১০-২৪ এর মধ্যে। যেই যুব সম্পদকে নিয়ে আমাদের গর্ব করার কথা, যাদের থাকার কথা ছিল শিক্ষাগ্রহণ আরদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর, সেই সম্ভাবনাময় তারুণ্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে মেথামফেটামিন (ইয়াবা) নামের এক মরণনেশা। আমাদের আগত প্রজন্মের কা-ারি যুবক সমাজের একাংশ আজও স্বপ্ন দেখে ঠিকই তবে তা নিতান্ত নেশার ঘোরে। বাংলাদেশ যখন দীপ্ত গতিতে সাফল্যের এক একটি মাইলফলক অতিক্রম করছে ঠিক তখনই নীরব ঘাতকের মত পিছু নিয়েছে সাংঘাতিক মরণব্যাধি ইয়াবা নামের এক মরণ নেশা, যা আমাদের জেনারেশনকে গ্রাস করে নিচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে আবার কখনও প্রকাশ্যে।
অন্যান্য মাদকের মত ইয়াবা যতবেশি ব্যবহার করে, প্রয়োজনটা তত বেশি বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ইয়াবার দীর্ঘ সময় ব্যবহার মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তিত হতে পারে। নিয়মিত মাদকের অপব্যবহার কাজের জীবনীশক্তি এবং উৎপাদনশীলতা ধ্বংস করে দেয়। মাদক সংক্রান্ত অর্থ সরাসরি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ ফৌজদারি অপরাধ কোন না কোনোভাবে ড্রাগ-সম্পর্কিত। মাদক ব্যবহারকারীরা সাধারণত মাদক কিনতে টাকা সংগ্রহের জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত হয়। মাদক অপব্যবহারে এইচআইভি এইডস ছড়িয়ে পরার একটি প্রধান কারণ।
উৎপত্তি স্থান মায়ানমারের থেকে সীমান্ত পথে ১৯৮০ সালের শেষ দিকে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন তেল স্টেশনে আজকের ইয়াবা তখন ইয়ামা নামে বিক্রি হত। মূলত ট্রাক চালকেরা দীর্ঘ পথ না ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর সুবিধার্থে ইয়ামা সেবন করত। কিন্তু দেখা গেল ট্রাক চালকেরা রাস্তায় প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটাতে লাগলো। বাধ্য হয়ে থাই সরকার ১৯৮৮ ইয়ামা বিক্রি নিষিদ্ধ করার পর জনপ্রিয় ইয়ামার প্রভাব কিছুটা কমলেও অবৈধভাবে উৎপাদন এবং বিক্রি বন্ধ ছিল না। ধীরে ধীরে ইয়াবার মরণনেশা ছড়িয়ে পরে থাইল্যান্ডের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, ঘরে-ঘরে। ভেঙে পড়েছিল সমস্ত সামাজিকতা আর নৈতিকতা। ইয়ামার প্রভাব, কার্যকারিতা আর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মাথায় রেখে থাই সরকার এই ইয়ামা নতুন নামকরণ করে ইয়াবা (উন্মাদ মাদক)।
ভয়াবহতা টের পেয়ে থাইল্যান্ড ইয়াবা নির্মূলে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ২০০৩ সালে, পরিণামে ৩ মাসে প্রায় ২০০০ সন্দেহভাজন মাদকব্যবসায়ী, ইয়াবা ডিলারদের হত্যা করা হয় অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২৫ জনকে। থাইল্যান্ডে ইয়াবার ভয়াবহতা এতো প্রকট হয় যে, মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে নিরাময় কেন্দ্র যেখানে গড়ে উঠার কথা ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি।
এদিকে থাইল্যান্ডের বাজার বন্ধ প্রায় হয়ে গেলে মায়ানমারের উৎপাদনকারীরা অভিন্ন সীমানার সুবাদে নতুন রুট বা গন্তব্য স্থল পেয়ে যায় বাংলাদেশ। শুরুতে উচ্চবিত্তদের হাতের নাগালে ইয়াবা সেবন সীমাবদ্ধ থাকলেও সময়ের পরিবর্তন, ব্যবহারকারী বৃদ্ধি আর প্রাপ্যতা সহজলভ্য হবার কারণে আজ ইয়াবা পৌঁছেছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, সব বয়সী মানুষের হাতের নাগালে। ভয়াবহতা খুব তীব্র, হয়ত খালি চোখে আমরা তা দেখছি না। ইউনাইটেড নেশনস-এর অন ড্রাগস এন্ড ক্রাইম রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে আশি লক্ষের কাছাকাছি মাদক ব্যবহারকারী আছে, যদিও সরকারের কাছে দেশে মাদকাসক্ত ব্যবহারকারীর নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বা তথ্য নাই। গবেষণা এবং ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট মতে, মাদক ব্যবহারকারীর মধ্যে ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ২০ দশমিক ৬ শতাংশ নারী, দেশজুড়ে যারা প্রতিদিন ৮০০ মিলিয়ন টাকার অবৈধ মাদক ক্রয় এবং সেবনের পিছনে ব্যয় করে। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি জার্নাল-এর তথ্য অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ অবিবাহিত; তাঁদের ৫৬ দশমিক ১ শতাংশ হয়ত ছাত্র নতুবা বেকার। মাদকের জন্য মূলত বাংলাদেশ একটি ফলপ্রসূ বাজার হিসেবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দাবি করে যে চোরাচালানকারীর মাধ্যমে দৈনিক ত্রিশ লক্ষ পিচ ইয়াবা আসে মায়ানমার থেকে আর মায়ানমারের সরুুরসধ.পড়স অনলাইন পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যা দৈনিক পঞ্চাশ লক্ষাধিক। যদি তাই হয় তাহলে বাংলাদেশে একবছরে কত ইয়াবা পিস আসে তা সহজে অনুমেয়। আর এসবের সেবনকারীরা ১৬ কোটি বাংলাদেশির কেউ না কেউ। এদের মধ্যে যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী, কিশোর, কিশোরী, কর্মজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে (৬৭৬১৪৩) সাতষট্টি লক্ষ একষট্টি হাজার তেতাল্লিশ পিচ ইয়াবা যা মূল পাচারকৃত সংখ্যার শূন্য দশমিক সাইত্রিশ শতাংশ মাত্র। এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝা যায় বাংলাদেশে ইয়াবার ভয়াবহতা।
এড়িয়ে যাবার সুযোগ নাই এই মহামারিকে। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। এই ভয়াবহতা বা ঝুঁকি কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তির নয়, সমগ্র জাতির। বায়ু যদি সংক্রমণ হয় আমাদের সবাইকে কিন্তু সেই সংক্রমিত বায়ুই গ্রহণ করতে হবে বেঁচে থাকার তাগিদে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে কানাচে এই মহামারি। থাইল্যান্ডের পথে কি হাঁটছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি? অবিলম্বে সরকারকে ইয়াবা নির্মূলে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। শুধু পাচারকারীর বিরুদ্ধে নয়, উৎপাদনকারী, বিক্রেতা, সরবরাহকারী, বহনকারী, ব্যবহারকারী সকলের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এরা যেই রঙের, দলের বা মতের হোকনা কেন সবাইকে অপরাধীর নজরে দেখতে হবে, দেখতে হবে দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু হিসেবে। একসঙ্গে কাজ করতে হবে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সদস্যদের। বিজিবি, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, শুল্ক বিভাগ র্যাবের সাথে প্রতিটি শ্রেণীপেশার মানুষদেরও সম্পৃক্ত হতে হবে এই মহামারি নিধনে সহায়তা করতে। এই ধরনের ক্রুসেডের জন্য অঙ্গীকার আসতে হবে সরকারের উচ্চ মহল থেকে। নতুন এবং যুগোপযোগী আইনের সাথে রাজনৈতিক অভিরুচিও অতীব প্রয়োজন ইয়াবার মত মরণনেশাকে রুখতে। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে এনজিওদের।
বিস্মিত হই যখন বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার স্থিতিশীলতার বিষয়ে চলমান দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস ও বিদ্রোহ, সংগঠিত অপরাধ এবং অস্ত্র বিস্তার বিষয়ক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মাসিক জার্নাল জেনের গোয়েন্দা পর্যালোচনায় বলা হয় বার্মায় কাছাকাছি পাচার সংস্থা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য নামমাত্র দামে ইয়াবা সরবরাহ করছে’। আমরা কি তাহলে বাংলাদেশের উদিত যুব সমাজের ধ্বংসের কোন ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি? সব শ্রেণীপেশার মানুষদের একাট্টা হয়ে মোকাবিলা করতে হবে মরণনেশা ‘মাদককে’, একসাথে ‘না’ বলতে হবে। নতুবা সময় সময়ে হেডলাইন পরিবর্তন হয়ে আমাদের সামনে প্রত্যাবর্তন হবে অতীতের অপ্রত্যাশিত সংবাদপত্রের হেডলাইন। পুলিশের পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যা করে তাদেরই মাদকাসক্ত মেয়ে ঐশী। শরীয়তপুরের নড়িয়ায় মাদকাসক্ত ছেলেকে নিজ হাতে কুপিয়ে খুন করেছে ছেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মা সালেহা বেগম।
বছর খানেক আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার এয়ারপোর্টে কয়েকবার ইয়াবা ধরা পরার পরপরই বর্তমানে এমনকি রোগ নিরাময়ের ওষুধ আনতে হলেও সাথে প্রেসক্রিপশন থাকাটা বাধ্যতামূলক করেছে কর্তৃপক্ষ; অন্যথায় গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন রকমের ল্যাবটেস্টের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অনেকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন বা অপরিচিত কারো জন্য প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ আনতে গিয়ে অকারণে হয়রানিসহ কারাদ- ভোগ করতে হয়েছে। সম্প্রতি পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হাম্মাদ আল থানি এক রাজকীয় আদেশে বেশ কিছু সাজাপাপ্ত কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে, যাদের মধ্যে ছিল একজন নারীসহ পনের জন বাংলাদেশি। উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে, পনের জনের মধ্যে বারজনই মাদক সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদের সাজায় কারাভোগ করেন।
উপসংহারে বলতে চাই, রোহিঙ্গাদের সাথে ইয়াবা শুধু বাংলাদেশে পুশইন হচ্ছে না, ইয়াবার সামান্য পরিমাণ কিন্তু বিদেশেও পাচার হচ্ছে। বিশ্বের কাছে আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই না মাদকের জন্য নিরাপদ স্বর্গরাজ্য বা মাদক পাচারকারি দেশ হিসেবে। প্রতিহত করার সময় এখনই, খুব দেরি হবার আগে।
নূর মোহাম্মদ নূর : প্রবাসী কমিউনিটি নেতা, কম্পিউটার প্রকৌশলী, কলাম লেখক