জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : ২০২১ সালের ২ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠে তৌফিকুর রহমান ইয়নের বিরুদ্ধে। সেদিন সংঘর্ষে ইয়নসহ পাঁচজন গুরুতর আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকায় ইয়নকে সেসময় চমেক হাসপাতালে ভেন্টিলেশনেও রাখা হয়েছিল।
এরপর একই বছরের গত ২৯ অক্টোবর রাতে ও ৩০ অক্টোবর সকালে মেডিকেল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এরপর কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায়ও তৌফিকুর রহমান ইয়নের জড়িত থাকার অযোগ উঠে। সংঘর্ষ এবং কলেজের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকায় গত ২৩ নভেম্বর তৌফিকুর রহমান ইয়নকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করে চমেক কর্তৃপক্ষ।
এর ছয় মাস পেরোতেই মঙ্গলবার (৭ জুন) বিকেলে চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে আকলিমা খাতুন নামের এক অন্তঃসত্ত্বা নার্সকে লাথি মারাসহ আরও কয়েকজন নার্সের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে তৌফিকুর রহমান ইয়নের বিরুদ্ধে; তিনি চমেকের ৫৮ ব্যাচের ছাত্র। ওই ঘটনায় শুধু ইয়ন নয়, অভিজিৎ দাশ (৬০ ব্যাচ), ইমন শিকদার (৫৮ ব্যাচ), কে এম তানভীর (৫৮ ব্যাচ), হৃদয় (৩১তম বিডিএস), জাকি আল হাসান (৬৩ ব্যাচ), জয় দে’সহ (২৭তম বিডিএস) আর বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার বিকেলে সেই হামলার ঘটনার পর থেকে ওইদিন রাত ৯টা পর্যন্ত চমেকের প্রধান ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন নার্স-স্টাফরা।
নার্সদের অভিযোগ, একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর স্বজনকে হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তির সময় দুইবার ফোন নম্বর জিজ্ঞেস করায় প্রথমে এক নার্সের সঙ্গে তৌফিকুর রহমান ইয়নের কথা কাটাকাটি হয়। এসময় ইয়ন ওই নার্সের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। একপর্যায়ে একজন গর্ভবতী নার্সের পেটে লাথি মারাসহ অন্য এক নার্সকে মারধর করেন ইয়ন।
এ ঘটনার পর গতকাল রাত ৯টার দিকে নার্সদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শাহেনা আক্তার। বৈঠকে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা ফের কাজে যোগ দেন।
এ বিষয়ে আজ বুধবার একটি বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ নার্সেস এসোসিয়েশনের চমেক হাসপাতাল শাখা। এতে উল্লেখ করা হয়, মেডিকেল ছাত্র ও ইন্টার্ন নামধারীদের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সভাপতি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ডিজি, এডিজি, ডিজিএনএম ও সেবা-তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে বাংলদেশ নার্সেস এসোসিয়েশন ও সকল নার্সের পক্ষ থেকে তিনটি দাবি জানানো হয়। প্রথমত, ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীদের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের ইন্টার্নশিপ চমেক হাসপাতাল থেকে বাতিল করতে হবে। তৃতীয়ত, নিরাপদ কর্মস্থলের ব্যবস্থা করতে হবে।
নার্সেস এসোসিয়েশনের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তদন্ত কমিটি আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে। দোষীরা শাস্তির আওতায় না আসলে দেশের সকল নার্সদের নিয়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে বিবৃতিতে।
এদিকে নার্সদের উপর হামলার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তৌফিকুর রহমান ইয়ন, অভিজিৎ দাশসহ তাদের সহযোগিরা ঘুরেফিরে বারবার অপরাধে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চমেকে সংঘর্ষের ঘটনায় ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর তৌফিকুর রহমান ইয়নসহ ১৬ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলাও দায়ের করা হয়েছিল। অভিজিৎ দাশের বিরুদ্ধেও থানায় মারামারির মামলা আছে। তাকে গত ২৩ নভেম্বর দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করে চমেক কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে নার্সেস এসোসিয়েশনের চমেক হাসপাতাল শাখার সদস্য শাকিল আজম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি অভিযুক্ত ইন্টার্ন চিকিৎসক তৌফিকুর রহমান ইয়ন প্রায়শই এ ধরনের অপকর্ম করে থাকেন। চমেকে বিভিন্ন সংঘর্ষেও তিনি অভিযুক্ত। আর মঙ্গলবারের ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা ইচ্ছাকৃত পরিকল্পিত হামলা। তারা রাজনীতি করেন বলে অন্তঃসত্ত্বা নার্সকে লাথি দেয়ার মত অপরাধ করতে পারেন না। তাদের হামলায় আমাদের কয়েকজন নার্স আহত হয়েছেন। আমরা আশাবাদী কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌফিকুর রহমান ইয়ন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তারা সকলেই ডা. শাহাদাতপন্থী। তারা উল্টো আমাকে এবং আমার কয়েকজন বন্ধুকে প্রচুর মারধর করেছে, যার ক্ষত আমার শরীরে এখনও আছে। পরবর্তীতে যখন আমাকে ধাক্কা দিচ্ছিল তখন আমি রাগের মাথায় একজনকে চড় মেরেছি। আর নার্সকে মারার প্রশ্নই আসে না। কারণ আমার নিজেরও বোন আছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইন্টার্ন চিকিৎসক এসোসিয়েশন চমেক হাসপাতাল শাখার সভাপতি ডা. মিনহাজ আরমান লিখন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যেসময় এসব ঘটনা ঘটছিল সেসময় আমরা বার্ণ ইউনিটে দগ্ধদের চিকিৎসা দিচ্ছিলাম। তারা চাইলেই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন। কারণ ওই সময় ছিল ক্রাইসিস মোমেন্ট। নার্সদের উপর হামলা করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। কারণ তারাই সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। আমরা প্রটোকল মেনে তাদের সহযোগিতা করে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় ইয়ন এবং অভিজিৎ চমেকে ঝামেলায় জড়িয়েছে। এজন্য তাদের বর্তমানে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এমন একটা ক্রাইসিস মোমেন্টে তাদের এ ধরনের ঝামেলা করা উচিত হয়নি। আর ওই স্থানে উপস্থিত অন্যরাও চাইলে বিষয়টা সহজেই সমাধান করে দিতে পারতেন, কিন্তু তারা তা করেননি। যেহেতু প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, আশা করছি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তা না হলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডিতে আহতদেরও চিকিৎসা দিতে নার্সরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাদের সাথে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত, অপ্রীতিকর। দায়িত্বরত অবস্থায় একজন নার্সকে মারধরের ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আমরা বাকিটা বলতে পারবো। এতোটুকু আশ্বস্ত করতে চাই, দোষী যেই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা আমরা নেব।’