সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে মানুষ মারলেও কেন হত্যা মামলা নয়?

প্রকাশিতঃ ৩০ মে ২০২২ | ১০:৪১ পূর্বাহ্ন


একুশে প্রতিবেদক : বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় সহজে হত্যা মামলা করা যাচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে কখনো অপমৃত্যু মামলা হচ্ছে। আবার কখনো দুর্ঘটনার ৩০৪ ধারায় মামলা হচ্ছে। উক্ত ধারাটি জামিনযোগ্য হওয়ায় আসামি গ্রেপ্তার হলেও কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তি পাচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গে ‘অশুভ আঁতাত’-এর কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত ১৯ মে দিবাগত রাত সাড়ে ১২ দিকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যানের ইন্ধনে জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের খুরুশকুল এলাকায় আবদুল খালেক (৩০) নামের এক যুবককে বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে হত্যার অভিযোগ উঠে। খালেকের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রাত ২টার দিকে লাশ নিয়ে আসে। এ নিয়ে ওই এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।

এরপর ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা মঞ্জুয়ারা বেগম ও তার সহযোগিদের নিজেদের বাড়িতে পাহারা দিয়ে রাখে পুলিশ। পরদিন ২০ মে সকালে অভিযুক্ত ১২ জনকে ‘জনরোষ থেকে বাঁচাতে’ লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পরে তাদেরকে থানায় নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা।

পরদিন ২১ মে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৭-৮ জনের বিরুদ্ধে আনোয়ারা থানায় মামলা করেন নিহত খালেকের বড় ভাই মো. ওমর ফারুক। কিন্তু অবাক করার মত ঘটনা হল যে, এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে দুর্ঘটনার ৩০৪ ধারায়।

যদিও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, “বিবাদীরা জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে বাদী ও বাদীর পরিবারের সদস্যদের জানমালের ক্ষতি করার সুযোগ খুঁজছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিবাদীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে, একই অভিপ্রায়ে বিরোধপূর্ণ ভূমিতে জোরপূর্বক সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দূরভীসন্ধিমূলকভাবে নির্মিত সীমানা প্রাচীরের সাথে বরই গাছের কাঁচা ডালপালা জড়িয়ে দিয়ে উক্ত কাঁচা ডালের সাথে সুকৌশলে গুনার চিকন তার পেঁচিয়ে; পেঁচানো তারের সাথে নিজেদের বসতঘরের বৈদ্যুতিক সংযোগ যুক্ত করে দেয়।”

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, “নিহত খালেক পেশায় একজন সিএনজি অটোরিকশা চালক। ঘটনার দিন রাতে স্থানীয় খুরুশকুল সেন্টারে অটোরিকশা রেখে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। এ সময় বিবাদীদের তৈরি বৈদ্যুতিক ফাঁদে জড়িয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন খালেক। এরপর তাকে আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।”

এজাহারে উঠে এসেছে, পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুতের ফাঁদ বসিয়ে খালেককে মারা হয়েছে। অর্থ্যাৎ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অপরাধ। কিন্তু এ ঘটনায় আনোয়ারা থানার পুলিশ মামলা রেকর্ড করেছে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায়। ৩০৪ ধারা হল অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর জন্য। আর ৩০২ ধারা হল ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য।

জানতে চাইলে মামলার বাদী ওমর ফারুক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলার এজাহারটি কম্পিউটার অপারেটর শাকিল লিখেছে। আমরা যেভাবে লিখতে বলেছি, সেভাবে শাকিল লিখেনি। সে বলে ওসি-তদন্ত স্যার যেভাবে লিখতে বলেছে, সেভাবে লিখবো। আমাদের কথামত না লেখার কারণে এজাহারে সাইন না করে চলে আসতে চেয়েছি। তখন কেউ কেউ বলেছে, ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেলে মামলা হয় না, হালকা হয়ে যায়।’

৩০২ ধারায় মামলা না করে ৩০৪ ধারায় করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে তো মার্ডার করা হয়েছে, এভাবে যে করে ফেলবে, আমরা তো কল্পনাই করিনি। এভাবে কারচুপি হবে, আমরা তো ভাবিনি। আমরা তো সাদাসিধে মানুষ। আইনের ধারা বুঝি না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা থানার ওসি এসএম দিদারুল ইসলাম সিকদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এজাহারে বিষয়টা যেভাবে আছে আমরা সেভাবেই মামলাটা নিয়েছি। এখানে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।’ বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন ওসি। পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি প্রত্যেকবারই কেটে দেন।

ইচ্ছাকৃত হত্যার ঘটনায় ৩০২ ধারায় মামলা হলে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডও হতে পারে। অন্যদিকে যে ৩০৪ ধারায় মামলা করা হয়েছে তা জামিনযোগ্য এবং সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। জামিনযোগ্য হওয়ায় ছয়দিনের মধ্যে গত ২৬ মে উক্ত মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মঞ্জুয়ারা বেগমসহ চার নারী আসামি জামিন পেয়েছেন। উক্ত মামলায় এজাহারভুক্ত আরও ৮ আসামি এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি বলে জানিয়েছেন বাদী ওমর ফারুক। অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল রোববার খুরুশকুলে মঞ্জুয়ারার বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। মঞ্জুয়ারার মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অন্যদিকে আরও একটি অবাক করা তথ্য হলো, গত ১৮ মে সকালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার জিয়ানগর আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় মো. সাগর (২২) নামের এক যুবক মারা গেছেন বিদ্যুতের ফাঁদে। এ ঘটনায় ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা দূর থাক, ৩০৪ ধারায় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মামলাও হয়নি। থানায় নিহতের ভাই হেলালের ‘সংবাদ’ দেয়ার ভিত্তিতে হয়েছে অপমৃত্যু মামলা। এর আগে ঘটনার পর বাগান মালিক মো. মুছা রাঙ্গুনিয়ার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ফসল ও গরু চুরি ঠেকাতে তিনি বিদ্যুতের ফাঁদ বসিয়েছিলেন। আর লিচু রাখার জন্য কলাপাতা কাটতে যাওয়া সাগর বিদ্যুতের ফাঁদে পড়ে মারা যান।

জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি মাহবুব মিল্কি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যার কথা বলছেন সে বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে মারা গেছে। পরে আমি তদন্তে জানতে পারি, বৃষ্টির দিনে সে কলা পাতা কাটছিলো, পরে গাছের সাথে থাকা তারে লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। তবে পরিকল্পিত হত্যার যে বিষয়টি আপনি বলছেন সেটাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের তদন্তে এমন কিছু পাইনি। তার পরিবার থেকেও কেউ অভিযোগ করেনি, এমনকি মামলা করতেও চাচ্ছিল না। তারপরও আমরা অপমৃত্যু মামলা নিয়েছি।’

মামলা করতে না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে নিহত সাগরের বড় ভাই মো. হেলাল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ভাই মরে গেছে, মামলা করলে সে তো আর ফিরে আসবে না। আর মুছা ঝামেলার মানুষ, ঝামেলায় জড়াতে চাইনি।’ মুছা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে কি না জানতে চাইলে হেলাল বলেন, ‘এক লাখ টাকা দিয়েছে।’

এর আগে ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার দক্ষিণ পাহাড়তলীর পাহাড়ি এলাকায় বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে ফেলে নিজাম উদ্দিন (৫৫) ও নজরুল ইসলাম (৪৫) নামের দুই কৃষককে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়।

এভাবে বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে চট্টগ্রামে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে, অথচ এসব ঘটনায় হত্যা মামলা হচ্ছে না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম রশিদুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে একের পর এক হত্যার অভিযোগ তো শুনিনি। আনোয়ারায় একটি ঘটনা ঘটেছে, কিছুদিন আগে। এ বিষয়ে থানায় মামলা হয়েছে। জড়িতদের ধরে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।’

আনোয়ারায় মামলা হয়েছে দুর্ঘটনার ৩০৪ ধারায়; এজাহারের বিবরণ অনুযায়ী, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হলেও ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা হয়নি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি তার অফিসে গিয়ে আইন নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দেন।

এদিকে বিদ্যুতের ফাঁদে শুধু মানুষ নয়, হাতিও মারা হচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ীদের শনাক্ত করা যায় না, হত্যা মামলাও হয় না। যদিও বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের ৩৬-এর(১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো বাঘ বা হাতি হত্যা করলে অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এই অপরাধ জামিন অযোগ্য। তিনি সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে শর্ত থাকে, বাঘ বা হাতির দ্বারা কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে এবং ফলে জীবনাশঙ্কার সৃষ্টি হলে জীবন রক্ষার্থে আক্রমণকারী বাঘ বা হাতিকে হত্যার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না।

তবে বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে হাতি হত্যার ঘটনায় সম্প্রতি সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও রাঙ্গুনিয়ায় হত্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বাবা-ছেলে পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন। অথচ রাঙ্গুনিয়ায় বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটলেও ৩০২ ধারা দূরে থাক, দুর্ঘটনার ৩০৪ ধারার মামলা পর্যন্ত হয়নি। মানুষ হত্যা করে পার পাওয়ার কী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত!

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রবীণ আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের ফাঁদ তৈরি করে মানুষ মারলে অপমৃত্যু মামলা হতে পারে না। কেউ আখ ক্ষেতে বিদ্যুৎ দেয়, বলা হচ্ছে শিয়াল ধরার জন্য। কিন্তু বিদ্যুৎ দিয়ে কোন প্রাণীকে মারার অধিকার কারও নেই। চোর ধরার জন্য বিদ্যুৎ আবিস্কার হয়নি। বিদ্যুতের ফাঁদে ফেলে কেউ মারা গেলে অপমৃত্যু মামলা করার প্রশ্নই আসে না। তারপরও পুলিশ অবৈধভাবে লাভবান হয়ে হত্যা মামলা করছে না।’

এক্ষেত্রে আইনের কোন দুর্বলতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইনের কোন দুর্বলতা নেই। দুর্বলতা হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। বিদ্যুৎ দিয়ে কারও সম্পত্তি প্রটেক্ট করতে আইন বলেনি। এটা হত্যা। হত্যা মামলা যারা রুজু করেনি, তারা দায়িত্বে চরম অবহেলা করেছে। এটা দুর্নীতি। পুলিশ টাকা নিয়েছে কী নেয়নি আমরা জানি না। টাকা নেয়া ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার অন্যতম বড় দুর্নীতি। হত্যার ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা নিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হওয়াটাই হচ্ছে আমাদের জন্য বড় সংকট।’

প্রবীণ আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী আরও বলেন, ‘৩০৪ ধারা হল অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর জন্য। আর ৩০২ ধারা হল ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য। আগে থেকে বিদ্যুতের ফাঁদ তৈরি করে মারার ঘটনাকে আমরা অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু অথবা অপমৃত্যু বলি কীভাবে? এগুলো হত্যাকাণ্ড। তাই হত্যা মামলাই হওয়া উচিত।’