একুশে প্রতিবেদক : সরকারি রাস্তা দখলের অভিযোগের পর এবার জোরপূর্বক অন্যের জমিতে চারতলা ভবন নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মির্জাখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে; অথচ ওই ভবন নির্মাণ না করতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১২ সালে মির্জাখীলের বাংলাবাজার এলাকায় প্রায় দেড় কানি জমিতে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ভবনটির নির্মাণকাজ এখন শেষ পর্যায়ে। ভবনটি নির্মাণ করার ক্ষেত্রে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও আইনকানুনের কোন তোয়াক্কা করা হয়নি। উপজেলার ইমারত/স্থাপনার নকশা অনুমোদন কমিটির অনুমোদন না নিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যে জমিতে মির্জাখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক চারতলা ভবন নির্মাণ করেছে, ওই জমির মালিক দাবি করে ২০১২ সালে সাতকানিয়া যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন আবদুল হামিদ নামের এক ব্যক্তি। মামলায় মির্জাখীল দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন শাহ সৈয়দ মোহাম্মদ আরেফুল হাইকেও বিবাদী করা হয়।
মামলা দায়েরের প্রেক্ষিতে আদালত কর্তৃক নিয়োগ করা এডভোকেট কমিশনার দলিলুর রহমান ও তার সহকারী সাইফুল ২০১৬ সালের ২৭ জুন বিরোধীয় জমি পরিদর্শন যান। পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায় দরবারের লোকজন। এসময় আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করেন। একই বছরের ২৯ জুন যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দেওয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে হামলার বিষয়টি তুলে ধরেন এডভোকেট কমিশনার দলিলুর রহমান।
একই ঘটনায় সাতকানিয়া আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগও করা হয়েছিল। বিরোধপূর্ণ জমিতে কোন কার্যক্রম না চালাতে আগামী ২৬ মে পর্যন্ত আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অন্যের জমিতে মাটি ভরাট করে চারতলা ভবন গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে মির্জাখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে সাতকানিয়ার মির্জাখীল এলাকার একজন বাসিন্দা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ভবনটির নির্মাণে আইনের কোন তোয়াক্কা করেনি মির্জাখীল দরবার কর্তৃপক্ষ। মানা হয়নি বিল্ডিং কন্সট্রাকশন এ্যাক্ট। অবৈধভাবে ভবনটি গড়ে উঠেছে। নকশা অনুমোদন না নিয়ে গড়ে তোলা ভবনটি যেকোনো মুহূর্তে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনাও। তখন এর দায়ভার কে নেবে?’
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা পরিষদ এবং উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তরের অসাধু কিছু কর্মকর্তাকে মোটা অংকের ‘ঘুষ’ দিয়ে সোনাকানিয়া মৌজার বিএস ৩৩০৯ দাগের ওপর নির্মিত চারতলা ভবনটির নকশা অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে মির্জাখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলা প্রকৌশলী পারভেজ সারোয়ার হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সোনাকানিয়া মৌজার অধীন বিএস ৩৩০৯ দাগের ওপর গড়ে তোলা চারতলা ভবনটির নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না জানি না। ভবনটি নির্মাণের আগে মির্জাখীল দরবার শরীফের পক্ষ থেকে নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে কি না সেটাও জানি না। এ সংক্রান্ত কোন তথ্য আমার কাছে নেই।’
অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি উপজেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী, নকশাকার এবং সাতকানিয়া উপজেলার ইমারত/স্থাপনার নকশা অনুমোদন কমিটির সদস্য সচিব জাকির হোসেনের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।
জানতে চাইলে সাতকানিয়া উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাবাজার এলাকায় মির্জাখীল দরবার শরীফের চারতলা কোন ভবনের নকশা অনুমোদন নেয়া হয়েছে কি না জানি না। আমার কাছে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই। ভবনটি অনুমোদনহীন হলে স্থানীয় চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে সোনাকানিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিনের মুঠোফোনে কল করা হলে অপর প্রান্ত থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি জানান, ‘তিনি (চেয়ারম্যান) অসুস্থ। কথা বলতে পারবেন না।’
এর আগে গত সোমবার দুপুরে সরেজমিন মির্জাখীল দরবার শরীফ এলাকায় গিয়ে বাংলাবাজার সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠা চারতলা ভবনটি ঘুরে দেখেন এ প্রতিবেদক৷ এসময় স্থানীয় একজন দোকানদার জানান, প্রায় তিন বছর আগে ভবনটির ৯০ ভাগ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। শক্ত কোন ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেনি ভবনটি। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে অভিযোগ করার সাহস কারও নেই। দরবারের লোক ছাড়া বাইরের কেউ সেখানে ঢুকতে পারেন না।
জানা গেছে, শুধু বাংলাবাজার নয়, পুরো সাতকানিয়া জুড়ে ভবন নির্মাণ সম্পর্কে অনিয়ম ধরিয়ে দিলেও প্রকৌশলীর দপ্তর কিংবা উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তাদের দাবি, উপজেলা পরিষদ এবং প্রকৌশল বিভাগের কিছু কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণের সুযোগ করে দিচ্ছে। ভবন নির্মাণে নিয়ম লঙ্ঘনকারী মির্জাখীল দরবারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নজির স্থাপন করা গেলে এরকম ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যের জমিতে জোরপূর্বক চারতলা ভবন নির্মাণ করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জাখীল দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন শাহ সৈয়দ মোহাম্মদ আরেফুল হাইয়ের ছেলে শাহ সৈয়দ মোহাম্মদ মকছুদুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কারা বলেছে নকশা অনুমোদন নেয়নি? তারা আমার সাথে কথা বলুক। আমরা এই নির্মাণাধীন ভবনটির নকশা অনুমোদন নিয়েছি এবং এটি দরবারের মালিকানাধীন জায়গায় গড়ে তোলা হচ্ছে। অন্যের জায়গায় হাসপাতাল গড়ে তোলার অভিযোগ ভিত্তিহীন, বানোয়াট।’
যদিও একাধিকবার সরাসরি দেখা করার পরও নকশা অনুমোদন নেয়া সংক্রান্ত কোন তথ্য সাতকানিয়া উপজেলার ইমারত/স্থাপনার নকশা অনুমোদন কমিটির সদস্য সচিব জাকির হোসেনও একুশে পত্রিকাকে দিতে পারেননি।
এদিকে গেট নির্মাণ করে সরকারি রাস্তা দখল করে গত ৩২ বছর ধরে মানুষের চলাচলের ওপর বাধা দিয়ে আসছে মির্জারখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষ। সেই বাধা অপসারণ করতে গত ১৪ এপ্রিল সাতকানিয়া উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছেন মামুন উদ্দিন নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা ফাতেমা-তুজ-জোহরা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করার জন্য এসি-ল্যান্ড সজীব কান্তি রুদ্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
গত ১৬ মে নিজের দপ্তরে এসি-ল্যান্ড সজীব কান্তি রুদ্র একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মির্জাখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গেট নির্মাণ করে সরকারি রাস্তা দখলের অভিযোগটি সরেজমিন তদন্তের জন্য স্থানীয় তহসিলদার মোহাম্মদ সেলিমকে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে স্থানীয় দেওদিঘি ভূমি অফিসের তহসিলদার মোহাম্মদ সেলিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সোনাকানিয়া মৌজার বিএস ৩৪৯৯ দাগের যে জায়গাটি দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে, প্রাথমিকভাবে সেটি সরকারি জায়গা বলে জানি। তবু বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করব।’
গেট নির্মাণ করে সরকারি রাস্তা দখলের অভিযোগের বিষয়ে মির্জাখীল দরবার শরীফের সাজ্জাদানশীন শাহ সৈয়দ মোহাম্মদ আরেফুল হাইয়ের ছেলে শাহ সৈয়দ মোহাম্মদ মকছুদুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে অনেক বছর ধরে অবাধে জনসাধারণ চলাচল করছে। কারও কোন সমস্যা হচ্ছে না। আর গেটটা তো দরবারের জায়গার ওপর। আপনার জায়গায় আপনি গেট দেবেন না?’
যদিও একই বিষয়ে তদন্ত করে ১৯৯৮ সালের ২৯ অক্টোবর একটি তদন্ত প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) শরীফ তৈয়বুর রহমান লিখেছেন, “এ কথা ভাবতে অবাক লাগে যে, মির্জাখীল দরবার শরীফ কর্তৃপক্ষ সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত রাস্তায় গেট নির্মাণ করে ০.২১ একর খাস রাস্তা দখল করার অভিপ্রায়ে ৭-৮ বছর যাবত দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত লড়াই করেছেন এবং সর্বত্র পরাজয় বরণ করেও পেশী শক্তি ও মাজার দরবার শরীফের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হতে পারে এ ধুয়া তুলে ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যাখ্যা দিয়ে এখনো গেটটি টিকিয়ে রেখেছেন। অথচ গেট মাত্র ৬-৭ বছরের পুরাতন, এটা অপসারণ করা হলে তাতে দরবার শরীফ বা মুরিদানদের কোনও অসুবিধা হবে না, বরং দরবার শরীফের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। সরকারি খাস জমি বা রাস্তার উপরে যদি পাকা গেট নির্মাণ করে তাতে পবিত্র কালেমা তৈয়ব লিখে তা দখল করা যায় এবং সরকার যদি তাতে সায় দেয় তবে ভবিষ্যতের জন্য এটা একটা খারাপ নজির থাকবে। কাজেই এ ধরনের কার্যকলাপ প্রশ্রয় দেয়া সঠিক পদক্ষেপ নয়।”
প্রতিবেদনে তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) শরীফ তৈয়বুর রহমান আরও লিখেছিলেন, “গেটটি উচ্ছেদের জন্য এর আগে আরও আটটি তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছিল।”
উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনের পর সাড়ে ২৩ বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনো গেটটি একই অবস্থায় আছে।