সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

বাবুলকে আসামি না করলে ‘আদালতে যাবেন’ শ্বশুর

প্রকাশিতঃ ৪ জুন ২০১৭ | ১:০২ অপরাহ্ন

চট্টগ্রাম: স্ত্রী খুনের পর বাদী হয়ে হত্যা মামলা করা সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে একই মামলায় আসামি হিসেবে দেখতে চান জানিয়ে তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলছেন, চার্জশিটে বাবুলের নাম না থাকলে তারা আদালতের আশ্রয় নেবেন।

গত বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে খুন হন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। কিন্তু এই খুনের কারণ ও নির্দেশদাতা কে ছিল- তা আজো জানা যায়নি।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অনেকদিন ধরে বাবুল আক্তারকে সন্দেহ করছি। সে ঘটনাস্থলে না থাকলেও সবকিছু করেছে। টাকা দিয়ে করিয়েছে। খুনের পর তারা ফোনে বাবুলকে জানিয়েছে, কাজ কমপ্লিট। পরিস্কারভাবে বলছি বাবুল ঘটনা ঘটাইছে। মিতু হত্যা মামলায় বাবুলকে আসামি করা হোক, গ্রেফতার করা হোক। ঘটনার সাথে আরও কেউ জড়িত আছে বলে আমাদের সন্দেহ। আমরা চাই, জড়িত সবাইকে পুলিশ ধরুক। নয়তো তদন্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বাবুলকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়া হলে আদালতে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব।’

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলায় পুলিশ যাদের ধরেছে তারা মূল আসামি হতে পারে। কিন্তু কার ইন্ধনে, কার নির্দেশনায় খুন হয়েছে, সেটা তো বের করতে হবে। মুছাকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পরপরই বাবুল আমাদের সাথে কথা বলেনি। অনেকদিন পরে যখন কথা হয়, তখন বলেছে, জঙ্গিরা মিতুকে মেরেছে। তার উপর জঙ্গিদের হুমকি ছিল। কিছু পুলিশ অফিসারের নাম বলেছিল, যারা তার ভালো চায় না, সে ভালো কাজ করুক সেটা চায় না বলেছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের কাছে আমরা কিছু ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেছি। তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি, এইগুলো দেখুন। আর বাবুলকে আমাদের সন্দেহ হয়। তাকে ধরে মোটিভ বের করতে হবে। বাবুলের দুটি পরকীয়া প্রেম আছে। এসব পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। পরকীয়া প্রেম থেকে হোক, অন্য কোন কারণে হোক, কাজটা বাবুল করেছে। বাবুল জড়িত বিধায় পুলিশের চাকরি গেছে। এখন বাঁচার জন্য ফন্দি করছে।’

মিতুর বাবা বলেন, ‘মেয়ের বাবা হিসেবে তো আমরাই মেইন। এখন আমরা সন্দেহ করছি বলেই তো বলছি। ২০১৩ সাল থেকে বর্নির সাথে বাবুলের সম্পর্ক। হাতে লেখা চিঠিসহ সব ডকুমেন্ট আছে। বাসায় আসলে দিতে পারবো। বাবুলের ছেলে-মেয়ে ঘটনা জানে। মিতু আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আমাদের বাসায় পালিয়ে আসতে চেষ্টা করেছিল। এখন বাবুল গ্রেফতার হলে বিষয়টি প্রমাণ হবে।’

অভিযোগের বিষয়ে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার বলেন, ‘উনি (শ্বশুর) একেক সময় একেক কথা বলছেন। কেন বলছেন, তাও আপনি ইতিমধ্যে জানেন। আমি ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে এসব জানিয়েছি। এরপরও ওনার কাছে যদি কোন তথ্য-প্রমাণ থাকে, তাহলে তা তদন্ত কর্মকর্তাকে দিতে পারেন। এসব বানোয়াট অভিযোগ নিয়ে না ভেবে আমি ছেলে-মেয়েকে সময় দিচ্ছি। তাদেরকে মানুষের মত মানুষ করার চেষ্টা করছি।’

এদিকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে মিতুকে হত্যার ঘটনার পরপর জঙ্গিদের সন্দেহ করে পুলিশ নেমেছিল সাঁড়াশি অভিযানে। তাতে দেশজুড়ে গ্রেফতার হয়েছিল কয়েক হাজার। কিন্তু হত্যার ২০ দিনের মাথায় তা মোড় নেয় অন্য পথে। ২৪ জুন রাতে ঢাকায় শ্বশুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুল আক্তারকে। গ্রেফতারের পর ২৬ জুন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় কিলিং মিশনে অংশ নেয়া মোতালেব মিয়া ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেন নামের দুজন। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, হত্যাকান্ডে অংশ নেয় মুছা, ওয়াসিম, নবী, আনোয়ার, রাশেদ, শাহজাহান ও কালু। অস্ত্র সরবরাহ করে ভোলা।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ হত্যাসহ বেশকিছু মামলার আসামি মুছা ছিলেন চট্টগ্রামে বাবুল আক্তারের সোর্স। পাশাপাশি অস্ত্রের জোগানদাতা এহতাশেমুল হক ভোলাও বাবুলের সোর্স বলে পরিচিত। খুনে অংশ নেয়া ওয়াসিম, আনোয়ার, ভোলা এবং শাহজাহান বর্তমানে কারাগারে আছে। পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ যায় নবী ও রাশেদের। পলাতক আছে মুছা ও কালু।

মুছার স্ত্রী পান্না আকতার বলেন, ‘গত বছর ২২ জুন বন্দর এলাকার বাসা থেকে মুছাকে নিয়ে যায় পুলিশ। তারা বলছে তিনি মিতু হত্যার সবকিছু জানেন। আমার কথা হচ্ছে, তাহলে মুছাকে প্রকাশ্যে এনে মিতু হত্যার রহস্য উন্মোচন করা হোক। মুছা যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে তাকে আইনগত প্রক্রিয়ায় সাজা দেয়া হোক।’

এদিকে গত ১৫ ডিসেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. কামরুজ্জামানের সাথে দেখা করতে চট্টগ্রামে আসেন বাবুল আক্তার। ২২ ডিসেম্বর তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন এসেও তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন। এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকায় গিয়ে বাবুলের শ্যালিকার সাথে কথা বলেন। এরপর গত ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এসে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ফের কথা বলেন মিতুর বাবা মোশাররফ ও মা সাহেদা মোশাররফ নীলা। এরপর থেকেই তদন্ত প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হচ্ছে না।

এদিকে স্ত্রীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের ‘পরকীয়ার’ কারণে ঝিনাইদহের বাসিন্দা এসআই আকরাম হোসেন খুন হয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন তার বোন জান্নাত আরা পারভীন। একই কারণে বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে প্রাণ দিতে হয়েছে বলেও অভিযোগ তার। গত ১৫ মার্চ মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে চট্টগ্রামে এসে সাংবাদিকদের এসব বলেন পারভীন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল বাহার বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলায় নতুন কোন অগ্রগতি নেই। মুছার নেতৃত্বে এ হত্যাকান্ড হয়েছে। তাকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা আছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মুছাকে ধরতে পারলে জানা যাবে, সে নিজের ইচ্ছায় করেছে নাকি, অন্য কারো দ্বারা নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে মিতুকে খুন করেছে। তবে তদন্ত দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেই। আমরা একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এরপর চার্জশিট দিয়ে দেব।’