একুশে প্রতিবেদক : জাতীয় নির্বাচনের বাকি আরও অন্তত দেড় বছর। কিন্তু অনেক আগেভাগেই শুরু হয়ে গেছে চট্টগ্রাম-১০ আসনে এমপি মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ।
দৌড়ঝাঁপকারীদের কেউ কেউ মনে করছেন– এই আসনের টানা তিনবারের সাংসদ, সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন দুইবছর ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত। তাই তিনি আর মনোনয়নের জন্য বিবেচিত না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মূলত সেই ধারণা থেকে এখনই মাঠে সরব ও সক্রিয় সংশ্লিষ্ট মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, বিএনপির মনোনয়নে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়া এম মনজুর আলম, নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, সাবেক চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, ওই আসনের ১২ নং সরাইপাড়া ওয়ার্ড, ২৩ নং উত্তর পাঠানটুলি ওয়ার্ড ও ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড থেকে টানা তিনবারের (১৬ বছর) সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু ও যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম মেম্বার মাহমুদুল হক।
আর এই বিষয়টি সামনে রেখেই আগাম শুরু হয়েছে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দৌড়ঝাঁপ। সাম্প্রতিক সময়ে এই আসন ঘিরে নিজেদের কর্মব্যস্ততাও বাড়িয়েছেন কেউ কেউ। এদের মধ্যে একজন তো মনেই করছেন আফছারুল আমীনের সময় শেষ, যে কোনো মুহূর্তে এই আসনে উপ নির্বাচন হতে পারে। সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা উছিলায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করেছেন, আকার-ইঙ্গিতে জানাচ্ছেন নিজের মনোবাসনার কথা। তবে বাকিরা হাঁটছেন ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে।
যদিও পুরো নগরজুড়ে নগর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে বিচরণের পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করছেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, দলে ও দলের বাইরে শক্ত ভিতের কারণে আগামীর কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনের জন্য দল আফছারুল আমীনের বিকল্প হিসেবে আ জ ম নাছিরকেই ভাবছেন। আর কেন্দ্রের সিগন্যাল পেয়ে আ জ ম নাছিরও এগোচ্ছেন সেই লক্ষ্য নিয়ে। বিষয়টি সামনে রেখে ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম ১০ নির্বাচনী এলাকার হালিশহর এলাকায় আ জ ম নাছির ফ্ল্যাটও কিনেছেন বলে শোনা যাচ্ছে তার কর্মী-সমর্থকদের মুখে।
জানা গেছে, দেশের দুটি প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাও নজর বাড়িয়েছেন চট্টগ্রাম ১০ আসনের দিকে। ইতোমধ্যে তারা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অবস্থান, জনসম্পৃক্ততা, সাংগঠনিক ভিত্তি, জনপ্রিয়তা বিবেচনাসহ কাকে প্রার্থী করলে শত প্রতিকূলতার মাঝেও এই আসনে জিতে আসতে পারবেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তসহ কেন্দ্রে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আলোচ্য সবার বিষয়ে কমবেশি আলোচনা এসেছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
আর সেই প্রতিবেদনে এম মনজুর আলমের নাম এক নম্বরে ও নিজের নাম দুই নম্বরে আছে জানিয়ে এই আসন থেকে জাতীয় নির্বাচন করার স্বপ্ন ও ইচ্ছার কথা স্বজন-শুভার্থীদের কাছে চাউর করছেন চট্টগ্রাম ১০ আসনের মানুষের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক না থাকা সাতকানিয়ার অধিবাসী সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত-সমালোচিত এক চিকিৎসক। তার সাথে চলাফেরা করেন এমন লোকদের দেওয়া তথ্যমতে, ওই চিকিৎসক এতটাই কনফিডেন্ট যে তিনিই নাকি পাবেন এই আসনে আগামীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। যদি কোনো কারণে মনোনয়ন হাতছাড়া হয় তাহলে আগামী সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনে মনোনয়নের স্বপ্ন দেখছেন তিনি। এই ফাঁকে ওই চিকিৎসক চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আসন্ন নতুন কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন বলে জানিয়েছেন তার কয়েকজন সতীর্থ। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা ওই চিকিৎসকের ডবলমুরিং আসন থেকে এমপি মনোনয়ন প্রত্যাশার বিষয়টিকে অতিরঞ্জন, বাড়াবাড়ি ও পাগলের প্রলাপ বলে মনে করছেন।
এদিকে, এমপি মনোনয়নের জন্য আলোচনায় থাকা অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু যে তিনটি ওয়ার্ড থেকে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, সেই তিনটি ওয়ার্ডের লোকসংখ্যা প্রায় চার লাখ। ভোটার প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি। অর্থাৎ আসনটির অর্ধেক ভোটার ও মানুষের তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন ২০০০ এর জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত। তাছাড়া তার নির্বাচনী এলাকার পাঠানটুলি ও সরাইপাড়া ওয়ার্ড হচ্ছে বিএনপি অধ্যুষিত, বহুকাল থেকেই এই দুটি ওয়ার্ডকে বলা হয় মিনি পাকিস্তান। সেই মিনি পাকিস্তান খ্যাত দুই ওয়ার্ড থেকে বিএনপির আমলেও সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জিতেছেন তিনি।একটি নির্দিষ্ট এলাকার কাউন্সিলর হয়েও বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করেছেন চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। সে কারণে তার আলাদা ভাবমূর্তি রয়েছে সকল মহলে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৮, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম ১০ আসন থেকে সরাসরি আমি মনোনয়ন চেয়েছিলাম। ২০০৮ সালে তৃণমূলের ভোটে তৃতীয় হয়েছিলাম। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন চেয়েছি চারবার। ২০১২ সালে সংরক্ষিত আসন ৪৫ থেকে ৫টা বাড়িয়ে যখন ৫০ করা হলো, তখন প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা, আমার পরম শ্রদ্ধেয়জন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। সেই কারণে ৫ জনের নতুন এমপির তালিকায় আমার নামও চলে আসে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন বিশেষ সহকারী সাইফুজ্জামান শেখর, ডা. আফছারুল আমীন আমাকে ফোন করে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাবু ভাই ফোনে এই সুখবর দিয়ে বললেন এখনই বেশি মানুষকে না জানাতে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ঘোষণাটা হয়ে যাক। কিন্তু পরদিনই মানিকগঞ্জে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন দেশের দুই কৃতী সন্তান মিশুক মনির ও তারিক মাসুদ। শোকে মুহ্যমান জাতি। সংসদে শোক প্রকাশ করা হলো। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে দেশের মানুষ। আর তখনই পিছিয়ে যায় এমপি ঘোষণা। পরে আমার বয়স আছে, পরবর্তীতে সুযোগ আছে এমন ধোয়া তুলে এক সিনিয়র নেত্রীর হস্তক্ষেপে আমার পরিবর্তে দক্ষিণ জেলার হাসিনা মান্নানের নাম ঘোষণা করা হয় এমপি হিসেবে।
রেহানা বেগম রানু বলেন, তাতে আমার কোনো কষ্ট বা আক্ষেপ নেই। যদি কিছু নাও পাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক কর্মী হয়েই থাকব আজীবন। আগামীতেও চট্টগ্রাম ১০ আসন থেকে সরাসরি মনোনয়ন চাইব। বিবেচনার ভার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার। তবে আমি নিশ্চিত বড় দায়িত্ব পেলে যোগ্যতা প্রমাণ করতে আমি সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।
গত সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন ও চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানুর নাম উচ্চারিত হওয়ার তথ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক প্রভাবশালী নেতা ওইসময় একুশে পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন, নেত্রী রানুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন। এক-এগারোর সময় নেত্রীর মুক্তির দাবিতে চট্টগ্রাম ৫ শতাধিক নারী নিয়ে আন্দোলন করার বিষয়টিও নেত্রী জ্ঞাত। সুযোগ পেলে নেত্রী রানুকে মূল্যায়ন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন সেই নেতা। সে হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন ও দলের জন্য অবদান ইস্যুতে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগী কর্মী রেহানা বেগম রানুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম ১০ আসনে মনোনয়ন দিলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না বলে মনে করেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।
চট্টগ্রাম ১০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশার ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী হিসেবে দীর্ঘদিন আমি নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বগুলো পালন করে এসেছি। ১৭ বছর জনপ্রতিনিধি হিসেবে সেবা করেছি। মানুষ আমাকে ভালো বলে কিনা জানি না, তবে মন্দ বলে না। ৪১ ওয়ার্ডে এখনও আমার বিচরণ আছে। যতটুকু পারছি মানুষের জন্য করে যাচ্ছি। হ্যাঁ, দেশ পর্যায়ে (এমপি হিসেবে) যদি এই সেবা পৌঁছে দিতে পারি সেটাও আমার জন্য বড় পাওয়া হবে।
এদিকে, বরাবরের মত এবারও নিজের মনোনয়ন প্রত্যাশার কথা জানান খোরশেদ আলন সুজন। একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময়ই এমপি হতে চেয়েছি। এখনও চাই। তবে সেটা চট্টগ্রাম- ১০ নয়, ১১ আসন থেকে। ১১ আসন থেকে আমি মনোনয়নও পেয়েছিলাম। কিন্তু যে কোনো কারণে পরে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন আমার জীবনের শেষ সময়, মনোনয়ন পেলে আলহামদুলিল্লাহ, না পেলেও আমার কোনো আক্ষেপ নেই।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবো। তবে আমাকে যেখান থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক না কেন আমি সেখান থেকেই নির্বাচন করবো। হোক সেটা ১০ আসন কিংবা সাতক্ষীরা। দল আমাকে যেই এলাকার দায়িত্ব দিবে আমি সেই এলাকা থেকে নির্বাচন করবো। মনোনয়ন পেলে মনে করবো মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ আমাকে দেওয়া হয়েছে। আর না পেলে একটা কষ্ট থেকে যাবে যে, মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সুযোগ পেলাম না।’
আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম-১০ আসনে থাকি না। সেই এলাকার ভোটারও না। আমি ১১ আসনের ভোটার। যেহেতু রাজনীতি করি, আশা-আকাঙ্ক্ষা তো আছে। একটা কিছু তো চাইবো। ওই আসন (চট্টগ্রাম-১১ আসন) থেকে মনোনয়ন চাইতে পারি। যদিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আরো প্রায় দু বছর বাকি।’
দল চাইলে চট্টগ্রাম ১০ আসনে প্রার্থী হবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে মনোনয়ন তো যে কোনো আসন থেকেই চাওয়া যায়। এখন দেখা যাক দল যদি মনে করে সেটা অন্য বিষয়। যখন এসবের প্রক্রিয়া শুরু হবে তখন আসলে বলা যাবে কী হচ্ছে। সময় আসলে মনোনয়ন চাইবো। – বলেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু।
এ ব্যাপারে বার বার চেষ্টা করেও আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অসংখ্যবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা গেলো তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন, তাই ফোন ধরতে পারছেন না।
যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম মেম্বার মাহমুদুল হককে ফোন করা হলে তিনি জানান, তিনি যুবলীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন, তাই এ মুহূর্তে কথা বলতে পারছেন না। ফ্রি হয়ে এক ঘণ্টা পর প্রয়োজনে তিনি নিজেই ফোন করবেন জানিয়ে আলাপ শেষ করেন। অবশ্য এক ঘণ্টা পর নয়, বিকেলে তিনি একুশে প্রতিবেদককে ফোন করে মনোনয়নের ব্যাপারে তার আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন।
মাহমুদুল হক বলেন, ‘চাওয়া-পাওয়া প্রতিটি মানুষেরই থাকে। আমারও আছে। চেষ্টা সবাই করে, আমিও করবো। তবে এখানে দলীয় সিদ্ধান্তটাই আসল। দল যদি মনে করে আমাকে দিয়ে কাজ হবে তাহলে আমাকে মনোনয়ন দিবে, যদি অন্য কেউ যোগ্য হয় তাহলে তাদের দিবে। রাজনীতি করার পেছনে আমার মূল উদ্দেশ্য মানুষের সেবা করা। একটা পদ-পদবি থাকলে সেই কাজটা অনেক সহজেই করা যায়। আমি আশা করছি। বাকিটা সময় হলে বোঝা যাবে।’