চট্টগ্রাম : রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠা চট্টলবীর মহিউদ্দিনপুত্র ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১০ সালে বাবার চতুর্থ মেয়র নির্বাচনে কাজ করার মধ্যদিয়ে। পরে আরও একদফা আলোচনায় আসেন ২০১৪ সালে এক এগারো সরকারের আমলে দায়ের করা দুদকের মামলায় বাবার পক্ষে চট্টগ্রাম আদালতে আইনী লড়াই ও এই ইস্যুতে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের কারণে। এরপর ২০১৪ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন-নাছির কমিটির কনিষ্ঠতম সদস্য হওয়ার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে উত্থান তরুণ এ নেতার।
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স থেকে স্নাতক করা নওফেল পরে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ল’ থেকে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করেন। এক-এগারোর সময়ে লন্ডনে অবস্থানরত বিদেশি আইনজীবী ও অর্থনীতিবিদদের একত্রিত করে শেখ হাসিনা মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের বাইরে জনমত তৈরির ভূমিকা রাখেন বলেও জানা যায় নওফেল।
জনশ্রুতি আছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরী পুত্রের জন্য স্রেফ একটা সদস্যপদ চেয়েছিলেন; কিন্তু দলের সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে ঢেলে দিলেন। করলেন দেশের প্রাচীনতম সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কনিষ্ঠতম সাংগঠনিক সম্পাদক। একেবারে যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি!
শুধু কি তাই? ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী আসনে বাঘা মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ও নুরুল ইসলাম বি.এসসিকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেন নওফেলকে। নির্বাচিত হন একাদশ সংসদের কনিষ্ঠ সদস্য। এরপর মন্ত্রীসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য অর্থাৎ শিক্ষা উপমন্ত্রী করা হয় ব্যারিস্টার নওফেলকে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত কম সময়ে রাজনীতির শীর্ষে আসা নেতার সংখ্যা আর আছে কিনা সন্দেহ। এজন্য বয়সে কনিষ্ঠতম এ রাজনীতিককে বলা হয় রাজনীতির ‘বরপুত্র’।
ব্যারিস্টার নওফেল যদিও দলের কনিষ্ঠতম সাংগঠনিক সম্পাদক (তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই), কনিষ্ঠতম এমপি, কনিষ্ঠতম মন্ত্রী; কিন্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা আর বিচক্ষণতায় জ্যেষ্ঠতম রাজনীতিকেরই পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন সর্বদা। বলা যায়, চট্টগ্রামে বাবার তৈরি মাঠে দারুণ খেলছেন তিনি, এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাবার বৃহৎ রাজনৈতিক বলয়।
চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আগে ছিল মহিউদ্দিন বনাম আ জ ম নাছির বলয়। সেই বলয় এখনো আছে, বরং আরও স্পষ্ট। আর সেই বলয়ের নাম হচ্ছে নওফেল বনাম নাছির বলয়। সেই বলয়, গ্রুপিং, চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি নানা বিষয় নিয়ে একুশে পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার আবছার রাফির সাথে কথা বলেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
চট্টগ্রামের গ্রুপিং ও কাঁদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, আমার সাথে কারও কোনো বিরোধ নেই। কারও সাথে প্রতিযোগিতাও নেই। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবও নেই। বরং আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে দলের সবার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। তবে হ্যাঁ, কারও সাথে মতবিরোধ থাকতে পারে, মতের পার্থক্য থাকতে পারে। মতপার্থক্য আছে, অনেক ইস্যুতে আছে। কিন্তু সবার সাথে একটা সৌজন্য এবং সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ আছে।
আমাদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ডা. আফছারুল আমীন সাহেব আছেন। উনার সাথে সব সময় দেখা হয়। উনি অসুস্থ এখন, আসতে পারেন না। ক্রিটিক্যালি চলাফেরা করছেন না। উনার সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানান বিষয়ে আমরা মিটিং করি, বৈঠক করি। সবার সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে। আমাদের সাবেক মেয়র সাহেব থেকে শুরু করে সবার সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। আমি যেহেতু মন্ত্রীপরিষদে আছি, আমার কাজ হচ্ছে সবার সাথে একটা সু-সম্পর্ক নিশ্চিত করা।
নওফেল বলেন, আমি তো শুধু জনপ্রতিনিধি না, সরকারের প্রতিনিধিও। যেহেতু সরকারের প্রতিনিধি, তাই এখানে সবার সাথে সম্পর্ক থাকতে হবে, একটা যোগাযোগ থাকতে হবে। বিশেষ করে আমি যেহেতু সরকারে আছি; এটা আমাদের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ। যেখানে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকার সুযোগ নেই। মাননীয় নেত্রী যেভাবে আমাকে রাজনীতি করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আমি সেই নির্দেশনা পালন করি। উনি আমাকে রাজনীতিতে পদায়ন করেছেন। উনার যে নির্দেশনা সেটা মেনেই আমি সব সময় সবকিছু করি। উনি যদি আবার বলেন যে, আমার এই রোল আমার জন্য প্রযোজ্য না বা আমার এই কাজ করার দরকার নেই তখন আমি করবো না। আমি শতভাগ উনার নির্দেশেই সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। যে আদর্শিক একটা গাইডলাইন উনি আমাদেরকে দেন সেটা নিয়ে আমি কাজ করি।
শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, তবে যারা স্বাধীনতাবিরোধী তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের সাথে আমাদের কোনো সন্ধি হবে না। তাদের সাথে সন্ধি-সম্প্রীতির কোনো সুযোগ নেই। আর কেউ যদি জাতির পিতার পরিবারকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদর্শের রাজনীতি করে, বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির বাইরে রাজনীতি করে; তাদের সাথে সম্প্রীতির কোনো সুযোগ নেই।
পিতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবদ্দশায় তুমুল বিরোধ ছিল চট্টগ্রাম ১১ আসনের সাংসদ এম এ লতিফের সাথে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসভবনে একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিলেন এম এ লতিফ। বাবার মৃত্যুর পর সেই লতিফের সাথে এখন নওফেলের সখ্য। গত ১৪ মেও নওফেলের চশমা হিলের বাসভবনে যান এমপি লতিফ। বেশকিছু সময় একত্রে কাটান তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, আমি তো উনার বাসায় গতবছরও গেলাম। এরপরই তো আসছে। উনি তো আমাদের বাসায় মেজবান খেয়েছেন। কে বলছে আসেনি? উনি তো অনেকবার আসছেন আমাদের বাসায়।
‘আমার আব্বা মারা যাওয়ার পর মেজবান হলো সেখানেও এসেছেন, না আসার তো কারণ নেই। আর আমি যেহেতু সরকারের মন্ত্রীপরিষদে আছি উনার যে-কোনো প্রয়োজনে উনি তো আমাদের সদস্য ওনি আসবেন। যে কেউ আমার কাছে আসতে পারেন, সেটা নিয়ে আলোচনা আসলে উচিত নয়।’- বলেন ব্যারিস্টার নওফেল।
নওফেল নলেন, এটা তো জায়গা-জমির বিরোধ না। আর উনি তো আমাদের দলের একজন সংসদ সদস্য। আমি তো সবার বাসায় যাওয়া-আসা করি। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা-ডিবেট থাকবে, সেটা যে কারও সাথে আমারও হতে পারে; তার মানে এই নয় যে, সামাজিকতা, সামাজিক সৌজন্যবোধ আমাদের মাঝে থাকবে না। রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও সামাজিকভাবে তো আমরা সবাই এক সমাজেই বসবাস করি। সুতরাং এখানে সবার সাথে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এবং এটাই হওয়া উচিত। আমাদের তো অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথেও একটা সৌজন্যমূলক সম্পর্ক আছে। সম্পর্ক যেহেতু আছে তাই অন্যান্য দলের রাজনীতিবিদদের দেখলে কুশলাদি বিনিময় করি।
বিভেদ, মতদ্বৈততা অনেকের সঙ্গে আছে, অনেক ইস্যুতে থাকতে পারে। আর কেউ সামাজিকভাবে আমার বাসায় আসলেই যে সেই বিভেদ বা ডিবেট দূর হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। যোগ করেন এ নেতা।