মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

সরেজমিন দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা : এক মাসে অর্জন কী?

প্রকাশিতঃ ৬ মে ২০২২ | ৯:০২ অপরাহ্ন


আবছার রাফি, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম) থেকে : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে প্রায় এক মাস আগে গত ৯ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা; এটির অবস্থান উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের রাজারহাট এলাকায়।

প্রাথমিকভাবে ২৬ জন জনবল দিয়ে নতুন থানার কার্যক্রম শুরু হয়। একজন পরিদর্শক (ওসি), তিনজন এসআই, চারজন এএসআই ও ১৮ জন কনস্টেবল রয়েছে উক্ত থানায়। এর বাইরে থানার অধীনে একটি তদন্ত কেন্দ্র (শিলক) এবং দুইটি ফাঁড়ি রয়েছে।

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার আওতায় রয়েছে রাঙ্গুনিয়ার শিলক, সরফভাটা, কোদালা ও পদুয়া ইউনিয়ন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দুর্গম এলাকায় এই চার ইউনিয়নের অবস্থান। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে অপরাধ করে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই পালিয়ে যায় অপরাধীরা। যার কারণে এখানে পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায়। থানা হওয়ায় এ চার ইউনিয়নে অপরাধ কমবে বলে আশা করা হচ্ছিল।

এমন অবস্থায় নতুন থানার কার্যক্রম শুরুর পর দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার হালচাল জানার চেষ্টা করে একুশে পত্রিকা। এরই অংশ হিসেবে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায় গিয়ে দেখা গেল, নতুন থানা হিসেবে এখানে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। অন্যান্য থানায় যেভাবে কম্পাউন্ড আছে, এখানে সেটা নেই। থানার গাড়ি আছে, কিন্তু গাড়ি রাখার নির্ধারিত কোনো জায়গা নেই।

ভাড়া নেয়া ভবনে চলছে থানার কার্যক্রম। ভবনের দুই ও তিনতলায় থানার কাজ চলে। একই ভবনে পুলিশ সদস্যদের থাকার ব্যবস্থাও আছে। তবে অন্যান্য থানায় ওসিদের জন্য একটা বাংলো থাকলেও এখানে তা নেই।

নতুন থানা হিসেবে নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার পুলিশ সদস্যরা। থানার যাত্রা শুরুর দিনই গত ৯ এপ্রিল সরফভাটা এলাকায় বড়ভাই ও ভাবীর হাতে ছোটভাই খুন হন। এ ঘটনায় জড়িত দুইজনকে ভুজপুর থেকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে র‌্যাবকে সহযোগিতা দেয় দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ।

গত একমাসে সরফভাটার ওই হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় মোট পাঁচটি মামলা হয়েছে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায়। একই সময়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত ৬ জন আসামির পাশাপাশি নিয়মিত মামলার আরও কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন এই থানার পুলিশ সদস্যরা।

এদিকে কার্যক্রম শুরুর একমাস হতে চললেও দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিযোগ এখন পর্যন্ত তেমন শোনা যায়নি। তবে কিছু এলাকায় সন্ত্রাসী, মাদক কারবারিদের অপতৎপরতা চলছে জানিয়ে এ বিষয়ে থানার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

জানতে চাইলে সরফভাটা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘দক্ষিণ সরফভাটার বরগুনা, চাকমা পাড়া, হাজারীখিল, মীরেরখিল, করলডেঙ্গার পাহাড়ি এলাকায় কিছু সন্ত্রাসী থাকে, যারা মানুষের ওপর অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন করছে, যারা একাধিক হত্যা মামলার আসামি; তাদের সম্পর্কে আইনশৃংঙ্খলাবাহিনী ওয়াকিবহাল। তারা প্রতিনিয়ত চাঁদার জন্য মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের দমনে সরফভাটায় একটা পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। আশা করেছি, পুলিশের তৎপরতা আরেকটু বাড়লে সন্ত্রাসীদের উৎপাত বন্ধ হবে।’

এ বিষয়ে শিলক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম তালুকদার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আপাতত দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার চার ইউনিয়নে তেমন কোনো বড় অঘটন হয়নি, বড় পরিসরে এখনো মানুষকে থানায় যেতে হয়নি। দুয়েকটা মামলা বা জিডি ছাড়া আর কিছু হয়নি। আমার এলাকা থেকে বেশি মানুষ এখনো যায়নি। আরও মাস দুয়েক গেলে, থানায় মানুষ যাওয়ার সংখ্যা বাড়লে তখন পুলিশি সেবার প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে।’

‘একজন বিচারপ্রার্থী মানুষ পরিষদে এসে সহজভাবে কথা বলতে পারে, আমরা সহজভাবে নিই। গায়ে কাঁদা নিয়ে কৃষক আসলেও আমাদের পাশে বসে সহজভাবে কথাবার্তা বলতে পারে; থানায় গিয়েও যেন এভাবে বলতে পারে, সে পরিবেশ ‍সৃষ্টি করে দিতে হবে পুলিশকে। তবে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায় এখনও সমস্যা দেখিনি।’ বলেন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।

থানার কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি মো. ওবাইদুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন থানা হিসেবে ভবন ভাড়া নিয়ে আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি। জায়গার স্বল্পতা আছে। এছাড়া থানার জনবল এবং অন্য সব বিষয় যথেষ্ট ভালো।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা ভালো মানুষ তাদের জন্য নতুন থানা হওয়ার ব্যাপারটা স্বস্তির। আর যারা খারাপ মানুষ তাদের জন্য খারাপ হয়েছে। আমি যদি এখানে একটা ভালো পরিবেশ করে দিতে পারি, সন্ত্রাস-মাদকমুক্ত করতে পারি, তাহলে এর ফল ভোগ করবে এখানকার জনগণ। আমি চিরস্থায়ী এখানে থাকবো না, থাকবে এ এলাকার জনগণ। এজন্য পুলিশের কাজে সহযোগিতার জন্য এলাকার সবাইকে আমি অনুরোধ করছি।’

খারাপ মানুষের সংখ্যা খুবই কম উল্লেখ করে ওসি মো. ওবাইদুল ইসলাম বলেন, ‘দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার বেশিরভাগ লোক ভালো, হয়তো মাদক কারবার করে কয়েকজন। আবার তাদের এ কাজে ইন্ধন দিচ্ছে কিছু লোক। এই কিছু মানুষের জন্য গ্রাম, মহল্লা, সমাজ বা দেশের বদনামটা হয়। এই গুটিকয়েক মানুষের জন্য যদি শান্তি বিনষ্ট হয় তাহলে আমরা কেন এসেছি? আমরা এসেছি জনগণকে শাসন করার জন্য নয়, সেবা করার করার জন্য। শোষণ করার জন্য আসিনি। এসেছি জনগণের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে একসঙ্গে কাজ করার জন্য। যারা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, অস্ত্রধারী- তাদেরকে আমরা কখনো ছাড় দেব না।’

থানার কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক কোনও চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না, কোনো রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধি কোনো মাদক কারবারির জন্য ফোন দেবেন। আর ফোন দিলেও আমার পক্ষ থেকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় পাবে না। এখন পর্যন্ত একটা মারামারির মামলায় দুই পক্ষেরই চাপ ছিলো- একপক্ষ মামলা নেওয়ার পক্ষে, আরেক পক্ষ মামলা না নেওয়ার পক্ষে। ঘটনা যেহেতু সত্য, তাই আমি মামলা নিয়ে আসামি আদালতে চালান দিয়েছি। আইনের ভেতর থেকে যেটা করার সেটা করেছি।’

দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানাকে ঘিরে দালাল চক্র গড়ে উঠতে পারবে না জানিয়ে ওসি ওবাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আগে লোহাগাড়ায় ছিলাম। সেখানে যেসব সাংবাদিক আছেন তাদের কাছে একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, দালাল-বাটপার ওসির রুমে গেছে, কিন্তু আমার রুমে ঢুকতে পারেনি। আমি তাদের প্রশ্রয় দিতাম না। সেখানে বিরাট নেতা সেজে এসে দালালি করে এমন লোককে আমি সরাসরি চেয়ার থেকে উঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি- যার সমস্যা সে এসে বলবে। তার কথা কি আমি শুনবো না? আপনি বলার কে? সোজা কথা, আমি এসব দালাল-বাটপারদের প্রশ্রয় দিই না।’