সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

দুই ঠিকানা দেখিয়ে সরকারি দুই স্কুলে চাকরি নিলেন তিনি

প্রকাশিতঃ ২৮ এপ্রিল ২০২২ | ৩:৪৬ অপরাহ্ন


এম কে মনির : প্রিয়া মুহুরী— চট্টগ্রামের রাউজানের বিনাজুরীর লেলিংগারার বাসিন্দা উল্লেখ করে ২০১৭ সালে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে সরকারি চাকরি নেন তিনি। এরপর রাউজানের এয়াছিন নগর ফকির টিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন এ নারী।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালীর আলকরণের বাসিন্দা উল্লেখ করে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে আবার নতুন করে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন প্রিয়া মুহুরী। এরপর থেকে বাকলিয়া থানাধীন চরচাক্তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।

দ্বিতীয়বার সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি নেওয়ার সময় প্রিয়া মুহুরী সহকারী শিক্ষিকা পদে আগের চাকরির তথ্য গোপন করেছেন বলে একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে।

যদিও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০১৯ এর ৫(খ) ধারায় উল্লেখ আছে, “সরকারি চাকরি কিংবা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চাকুরিতে নিয়োজিত থাকাকালীন স্বীয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দরখাস্ত দাখিল না করলে কোনো পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হবে না।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কর্মরত কোন কর্মচারী একই পদে পুনরায় চাকরি পেতে আবেদন করতে পারেন না। যার কারণে বৈধভাবে দ্বিতীয়বার সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ প্রিয়া মুহুরীর নেই। অবৈধভাবে তিনি চাকরিটি না নিলে বেকার অন্য কোন নারী জীবিকা নির্বাহের অবলম্বনটি পেয়ে যেতেন।

তথ্য গোপন করে চাকরি নেয়ার পর ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাকলিয়া থানাধীন চরচাক্তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করে আসছেন প্রিয়া মুহুরী।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিয়া মুহুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার একটাই চাকরি, একটাই ঠিকানা।’ দুই ঠিকানা দেখিয়ে সরকারি দুই স্কুলে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এসব আপনারা তদন্ত করে বের করেন। আমাকে এসব ফালতু বিষয়ে ফোন করবেন না। আমি একটাই চাকরি করি এবং রাউজানে কখনোই ছিলাম না।’ বলেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন প্রিয়া মুহুরী।

একই বিষয়ে প্রিয়া মুহুরীর ভাই, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা বিধান মুহুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি জানতাম আমার বোন চট্টগ্রাম শহরে একটি স্কুলে চাকরি করেন। কোন স্কুল থেকে কোন স্কুলে বদলি হয়েছেন সেসব বিষয়ে কিছুই জানি না। বিয়ের পর তারা আলাদা থাকে। এসব আমার জানার কথা নয়।’

প্রিয়া মুহুরী ও তার ভাই অভিযোগ অস্বীকার করলেও রাউজানের সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মোমেন অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

আব্দুল মোমেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রিয়া মুহুরী ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে চাকরি করতে পারবেন না উল্লেখ করে অব্যাহতির আবেদন করেন এবং ওইদিনই তার আবেদনের প্রেক্ষিতে সেটি মঞ্জুর করেন জেলা শিক্ষা অফিসার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার তখন মনে হয়েছিল প্রিয়া মুহুরী তথ্য গোপন করছেন। কেননা আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি যে সরকারি চাকরি কেন ছাড়ছেন? তিনি বারবার বললেন, তার ব্যক্তিগত কারণে। এভাবে তথ্য গোপন করে একই পদে দুটি চাকরি নেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি।’

তবে একই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিয়া মুহুরীর পক্ষে সাফাই গেয়ে বাকলিয়ার চরচাক্তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সৌমা দত্ত একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রিয়া মুহুরী এখানে যোগদান করেছেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। এভাবে একটি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে আরেকটি চাকরি করা যায়। এতে কোন সমস্যা নাই।’

সৌমা দত্ত উল্টো এ প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, ‘সংবাদকর্মী হয়ে আপনি কি একজন সহকারী শিক্ষিকা সম্পর্কে জানতে চাইতে পারেন? সংবাদকর্মী হলে কি হবে? আপনি কি ওনার আত্মীয়?’ তখন এ প্রতিবেদক বলেন, ‘সংবাদকর্মী হিসেবে অবশ্যই জানতে চাইতে পারি। তাছাড়া অনুমতি না নিয়ে ভারতে যাওয়ার অভিযোগও আছে প্রিয়া মুহুরীর বিরুদ্ধে।’ এ কথা বলার পর প্রধান শিক্ষিকা সৌমা দত্ত বলেন, ‘প্রিয়া মুহুরী সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমেই জানলাম। এভাবে তথ্য গোপন করে একই পদে চাকরি নেয়ার কোন সুযোগ নেই। সরকারি চাকরি নিয়োগ বিধিমালায় উল্লেখ আছে আবেদনকারী কোন তথ্য গোপন করতে পারবেন না। এ বিষয়ে কেউ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য গোপন করে কেউ চাকরি নিলে তার প্রমাণ পাওয়া গেলে যেকোন সময় তিনি চাকরি হারাতে পারেন। তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেলে যেকোন সময় যেকোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।’

এদিকে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করার সময় সরকারের বিনা অনুমতিতে ভারতে যাওয়া আসার অভিযোগও আছে প্রিয়া মুহুরীর বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘কোন সরকারি কর্মচারী এনওসি নেয়া ছাড়া দেশের বাইরে যেতে পারেন না। তিনি সেটি লঙ্ঘন করেছেন কি না সেটা খতিয়ে দেখার পর জানাতে পারবো।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইটি) মো. আবু রায়হান দোলন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘তথ্য গোপন করে কেবল সরকারি চাকরি নয়, কোন কিছুই করার সুযোগ নেই। তিনি যদি মিথ্যা তথ্য দেন, সেটি অবশ্যই বেআইনি। এছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে জেলা প্রশাসকও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। এ ধরণের অপরাধ করলে সরকারি চাকরি বিধিমালায় যে শাস্তির বিধান রয়েছে তাই তার উপর প্রযোজ্য হবে।’