সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

পাহাড়ি ছড়ায় ইউনিটেক্সের বাঁধ, হুমকিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

প্রকাশিতঃ ২৪ এপ্রিল ২০২২ | ৭:০৫ অপরাহ্ন


এম কে মনির : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়ায় একটি পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে পানি উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে ইউনিটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে; স্থানীয়ভাবে বোয়ালিয়াকুল ছড়া নামে পরিচিত এ ছড়াটিতে বাঁধ দেয়ার ফলে ওই এলাকায় পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।

এছাড়া সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরাও। ছড়া শুকিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে পড়েছে ছড়ার জলজ প্রাণি-পাহাড়ি উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য। সংকীর্ণ হয়ে আর গতিপথ পাল্টে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে গ্রামীণ জনজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এ ছড়াটি।

সরেজমিনে দেখা যায়, বারআউলিয়া হাইওয়ে থানার পূর্বে অবস্থিত ছড়াটিতে সিমেন্টের ব্যাগে তৈরি জিওব্যাগ দিয়ে আড়াআড়িভাবে একটি উঁচু বাঁধ দেয়া হয়েছে। এতে একদিকে ছড়ার নিন্মভাগ শুকিয়ে গেছে। অন্যদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি একটি নির্দিষ্ট কূপে জমা হচ্ছে। যা ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলস তাদের মোটর পাম্প দ্বারা প্রায় ৫শ’ মিটার লম্বা পাইপ দিয়ে কারখানায় সরবরাহ করছে।

ছড়ার আশেপাশের গাছপালা, উদ্ভিদ শুকিয়ে মৃত প্রায় দেখা গেছে। তীব্র পানি সংকটে আশেপাশের কৃষি জমিগুলোর সেচ ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে। বাঁধের দক্ষিণ পাশে ইউনিটেক্সের সীমানা নির্ধারণের কাজও চলমান রয়েছে। সীমানা নির্ধারণে ছড়ার পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে মাটির উঁচু বাঁধ। সদ্য নির্মিত ওই বাঁধের মাটিগুলো গড়িয়ে পড়ছে ছড়ায়। ফলে ছড়াটি ভরাট হয়ে দিনদিন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার।

আশকর পাড়ার একজন বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানকার প্রাকৃতিক পানির একমাত্র উৎস পাহাড়ি ছড়া। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলস বেয়ালিয়াকূল ছড়ায় বাঁধ দিয়ে পানি উত্তোলন করছে। এ যেন ছড়ার পানিতে তাদের একক রাজত্ব। তাছাড়া ছড়াটি বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল নামার একমাত্র পথ হওয়ায় বন্যা থেকে বাঁচার একমাত্র ভরসাও। কিন্তু বাঁধ দিয়ে ছড়াটিকে পানি চলাচলের অনুপযোগী করে তোলায় আগামী বর্ষায় আমাদের বাড়িঘর ডুবে যেতে পারে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন কৃষক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা পানির অভাবে চাষাবাদ করতে পারছি না। কেননা ছড়ার পানি আমরা পাই না। সব পানি ইউনিটেক্স নিয়ে যাচ্ছে।’ একই কথা বলেন, পাহাড়ের একজন জুম চাষীও। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা পাহাড়ে জিঙ্গা, করলা, শসা, বরবটিসহ হরেক রকম সবজি চাষ করি। এসব সবজি উৎপাদনে পানি প্রয়োজন। কিন্তু ইউনিটেক্সের পানি উত্তোলনের কারণে ক্ষেতে সেচ দেয়া যায় না।’

জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলার প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই পাহাড়ি ছড়ায় অবৈধভাবে বাঁধ দিয়েছে ইউনিটেক্স স্পিনিং মিলস। যদিও পানি আইনে বলা হয়েছে, বাঁধ দ্বারা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ও পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিটেক্সের পক্ষে সাফাই গেয়ে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাহাব উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরাই ইউনিটেক্সকে বাঁধ তৈরি করে দিয়েছি। শিল্পের চেয়ে পরিবেশ বড় নয়। সেখানে অনেক মানুষ কাজ করছে। পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি উত্তোলন করলে কী হয়েছে? এতে সমস্যা কী? পরিবেশ কোথায় হুমকিতে পড়লো? এখানে কোন কৃষকের সমস্যা হচ্ছে না।’

এ বিষয়ে জানতে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জাহাঙ্গীরের মুঠোফোন একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিটেক্স গ্রুপের পরিচালক (লিগ্যাল এন্ড স্টেইট) ফারহান আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পাহাড়ি ছড়ায় আমরা কোন বাঁধ দিইনি। স্থানীয়রা আপনাদের ভুল বুঝিয়েছে। সেখানে আমাদের কোন কার্যক্রম নেই।’

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পাহাড়ি ছড়ায় বাঁধ দেয়ার নিয়ম নেই। এ বিষয়টি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা শীঘ্রই বাঁধের স্থানটি পরিদর্শনে যাব। পরিবেশকে হুমকিতে ফেলে বাঁধ তৈরির সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’