মোহাম্মদ রফিক : বেলায়েত (৬৫)। ইটভাটার একজন শ্রমিক। ভোরের আলো ফোটার আগেই চট্টগ্রামের হাটহাজারীর চারিয়ার একটি ইটভাটায় কাজ করতে চলে আসেন তিনি। ৪ বছর ধরে তিনি সেখানে কাজ করছেন। প্রতিদিনি কাজ চলে বিরতিহীনভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। দিনে দেড় থেকে দুই হাজার পোড়ানো ইট ভাটা থেকে তুলে তিনি মজুরি পান ৩৫০ টাকা।
এক মাসে যা আয় হয়, তা দিয়ে বেলায়েতের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সংসার চলে। কিন্তু এ টাকা দিয়ে পরিবারের সবার ঠিকমতো খাবার জুটে না। তবুও ইটভাটা ছেড়ে যেতে পারেন না তিনি। পোড়া ইটের ছাই নাক-মুখ দিয়ে অবিরাম ঢুকছে। শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবু তাকে টানতে হচ্ছে পরিবারের ঘানি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলায়েত বলেন, ‘দাদনের শিকলে আমার হাত-পা বাঁধা। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন।’
শুধু বেলায়েত নয়, চট্টগ্রামের শত শত ইটভাটার শ্রমিকদের জীবন চলছে বেলায়েতের মতোই। শ্রম অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের ৪০৮টি ইটভাটায় প্রায় অর্ধ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তাদের অধিকাংশই শ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে গ্রামাঞ্চল ক্রমশ পরিণত হচ্ছে ইট-সুরকি-চুনের শহরে। এসব কাজে ভুমিকা রয়েছে ইটভাটার শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনি। সরকারি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রামের ৪০৮টিসহ সারাদেশে ১১ হাজার ইটভাটা রয়েছে। মৌসুমভিত্তিক এ কাজে শ্রমিকদের কঠিন শর্তে কাজ করতে বাধ্য করে মালিক পক্ষ। এসব ইটভাটায় যে সকল শ্রমিক (নারী ও পুরুষ) কাজ করেন তাদের মজুরিও অনেক কম। তাছাড়া এদেশে প্রায় দেড়শো বছর আগের প্রযুক্তিতেই কাজ করতে হয় তাদের।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইট তৈরির প্রযুক্তি সেকেলে। প্রথমে মাটি সংগ্রহ করতে হয়। তারপর সেগুলোকে পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে হাতের সাহায্যে মল্ড তৈরি করে রোদে শুকাতে হয়। পরে শুকানো হয়ে গেলে চূড়ান্তভাবে চূল্লিতে পোড়ানো হয়। প্রতিবছর প্রায় চার হাজার চুল্লিতে দুই মিলিয়ন টন কয়লা এবং দুই মিলিয়ন টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়।
সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা যায়, বায়ুদূষণে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১তম যা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বিরাট স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত। আর অধিকাংশ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। শ্রমিকরা যথেষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।
হাটহাজারীর একাধিক ইটভাটার শ্রমিকরা জানান, প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় ইটভাটায়। এই শীতের মধ্যেও ভোর থেকে অনায়াসে মাটি আর পানি দিয়ে ইটভাটায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শত শত শ্রমিক।
হাটহাজারীর কয়েকটি ইটভাটা সরেজমিনে দেখা গেছে, শীত আর কুয়াশার মধ্যে ভাটার স্তুপ থেকে গুলানো মাটি নিচ্ছেন বেশ কিছু শ্রমিক। কেউ কেউ ভাটা থেকে পোড়া ইট মাথায় নিয়ে স্তূপে রাখছেন। আবার কেউ ট্রলি দিয়ে ইট বানানোর লাইনে মাটি নিচ্ছেন। কেউ বানিয়ে যাচ্ছেন ইট।
ইটভাটার শ্রমিকেরা জানান, প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় ইটভাটায়। প্রচণ্ড শীতেও তাদের কাজ করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে সাতক্ষীরা থেকে আসা শ্রমিক আবুল কালাম বলেন, ‘এমবিআই ইটভাটায় কাজ করি। এ শীতেও রাত ২টায় ঘুম থেকে উঠি। ৩টা থেকে কাজ শুরু হয়ে চলে সকাল ৭টা পর্যন্ত। কাজের সময় কোনো শীত লাগে না। কাজের ব্যস্ততায় শীত বা কুয়াশা বোঝা যায় না।’
কুষ্টিয়া ভেড়ামারা থেকে আসা শ্রমিক আব্দুল আহাদ বলেন, ‘ভোর থেকে ইটভাটার গোলা (মাটির স্তুপ) থেকে মাটি কেটে ট্রলিতে ভরে মেশিনে দেওয়া শুরু করি। শুরুতে শরীরে শীতবস্ত্র থাকলেও পরে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে খুলে রাখি। এভাবে চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। কাজ শুরু করার সময় কিছুটা শীত লাগলেও কাজ শুরুর পরে শীত লাগেনা।’
ফেনীর ছাগলনাইয়্যা উপজেলার চার ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের বাবা আজমল হোসেন বলেন, ‘সারা বছর এলাকাতে ভ্যান চালাই। কার্তিক মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত চট্টগ্রামে এসে ইটভাটায় কাজ করি। সকালে কাজে আসার সময় শীত অনুভব করলেও কাজের সময় কোনো শীত লাগে না।’
শ্রমিকেরা জানান, প্রতিটি ইটভাটায় ৩০-৩৫ জন করে শ্রমিক কাজ করেন। ভাটা থেকে গুলানো মাটি নিয়ে ইট বানানো পর্যন্ত তাদের কাজ। প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা বেতন পান তারা। তবে ইটভাটার মালিক থেকে তাদের ‘মাঝি’ আরও বেশি টাকা নেন। যারা ইট বানান তাদের বেতন একটু বেশি। দরিদ্রতার কারণে ইটভাটায় কাজ করেন এসব শ্রমিকেরা। সারা বছর রিকশা ভ্যান বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে খাওয়া এসব শ্রমিকেরা ইটভাটা থেকে আয়ও করে সংসার চালান অনেকে।
হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক আবাসিক চিকিৎসক ডা. ইমতিয়াজ জানান, ‘শ্রমিকরা ইটভাটার ছাই, শীত আর কুয়াশার কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবা, সুরক্ষার বিষয়টি ইটভাটা মালিকদের নিশ্চিত করা উচিত।’
এদিকে ইটভাটার কারণে কৃষকরা জমি হারাচ্ছেন। মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে। ভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশ ও কৃষি ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর দেশের মোট চাহিদার ২৫ থেকে ২৬ শতাংশ জ্বালানি কাঠ ইটভাটা গুলোতে ব্যবহার করার ফলে ব্যাপকহারে বন-জঙ্গলও উজার হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত ইটভাটার তিন চতুর্থাংশই অবৈধ। জনবল সংকটের অজুহাতে ইটভাটার বিধংসী কর্মকান্ড থামাতে পারছে না। জানা গেছে, গেল বছর লোহাগড়া উপজেলায় ৭টি, ফটিকছড়ির ৫টি, হাটহাজারীর ৫টি, রাউজান উপজেলার ৭টি ইটভাটাসহ প্রায় ৩০টি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলায় চার ভাগের তিনভাগ ইটভাটা অবৈধ। অনেক এলাকায় প্রভাবশালীদের কারণে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি অনেক উপজেলায় কত ইটভাটা আছে সেগুলোর বিষয়ে তথ্য চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রশাসন সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম জেলার মতো একটি বড় জেলায় রয়েছেন মাত্র চার জন কর্মকর্তা।’
পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৪১০টি। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি (৮০-১২০ ফুট) ২৮৪টি, জিগজ্যাগ চিমনি ১২১টি এবং অনান্য ইটভাটা আছে ৩টি। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এসব ইটভাটার মধ্যে ৩১০টির পরিবেশগত ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা অনুমোদনপত্রই নেই।
সরকারি তথ্যমতে, রাউজানে ৩৬টি, ফটিকছড়িতে ৪৬টি, সাতকানিয়ায় ৩৮টি, হাটহাজারীতে ৪০টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৭১টি, চন্দনাইশে ৩২টি, লোহাগাড়ায় ১৫টি, আনোয়ারায় ৩টি, বাঁশখালীতে ৩টি, সন্দ্বীপে ৪টি, মিরসরাইয়ে ৮টি, সীতাকুণ্ডে ৫টি, বোয়ালখালীতে ৭টি, পটিয়ায় ৩টি ইটভাটা অবৈধ। তবে বাস্তবে উপজেলাগুলোতে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা আরও অনেক বেশি।