মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১

আইন লঙ্ঘন করে ‘বে ওয়ানের’ সমুদ্রযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিতঃ ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২ | ১:২৪ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে ২৫ বছরের পুরনো জাহাজ সাগরে ভাসানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন রুটে যাত্রী পরিবহন করা ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ ২৯ বছরের পুরনো।

এরপরও গত বছর ১৪ জানুয়ারি কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের মালিকানাধীন প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। বেশ পুরনো হওয়ায় জাহাজটি যেকোনো সময় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে- এমন শঙ্কা তখন থেকেই ছিল।

অবশেষে শঙ্কা সত্যি হলো। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাট থেকে পর্যটক নিয়ে জাহাজটি বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২০ মিনিটে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা যাওয়ার পর যাত্রার ক্লান্তিতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। আবার ভ্রমণের আনন্দে আড্ডা-গল্পে মশগুল অনেকেই। কেউবা ব্যস্ত গভীর রাতের সৌন্দর্য উপভোগে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে ভেসে আসে ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার। মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জাহাজজুড়ে।

জাহাজটিতে সেসময় অবস্থান করা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাহাজের ওপরের ডেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল, ফলে অধিকাংশ যাত্রী সেখানেই জড়ো হয়েছিলেন। এসময় ইঞ্জিন রুমে আগুন লাগার কথা জানতে পেরে আতঙ্কিত যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, তারা নিচে নেমে লাইফ জ্যাকেট পরতে শুরু করে। এসময় জাহাজের লোকজন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এসময় একটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।

ফলে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেল এলাকায় ইঞ্জিন চলা ছাড়াই জাহাজটি ভেসেছিল। আগুন নিভে যাওয়ার পর জাহাজটিকে অপর ইঞ্জিনের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু যাত্রীরা সেন্টমার্টিন যেতে রাজি হননি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বন্দরের টাগবোট কাণ্ডারি-১০ ঘটনাস্থলে যায়, এর মাধ্যমে সেন্টমার্টিনের পরিবর্তে চট্টগ্রামে ফিরিয়ে আনা হয় প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’- কে।

প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’- এর এমন দুর্ঘটনায় পর নতুন করে সামনে আসতে শুরু করেছে জাহাজ সংশ্লিষ্ট নানা অনিয়ম ও অসংগতির বিষয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি জাহাজের ২৫ বছর পার হলে জাহাজটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। সে অনুযায়ী এই জাহাজটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে আরও ৪ বছর আগেই। ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে জানান তারা।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বে ওয়ান ক্রুজ জাহাজটির মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাপানের মিতশুবিশি হেভি ইন্ড্রাস্টিজ লিমিটেড। ১৯৯২ সালে সালভিয়া মারু নামে জাহাজটি আত্মপ্রকাশ করে। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে ২৯ বছর অতিক্রম করেছে জাহাজটি। ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব ক্লাসিফিকেশন সোসাইটিস’র নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনো জাহাজের গড় আয়ু নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ২৫ বছর।

অভিযোগ উঠেছে, ৪ বছর আগে আয়ুষ্কাল হারানো জাপানে তৈরি ‘সালভিয়া মারু’কে সংস্কার করে বিলাসবহুল প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিন রুটে চালাচ্ছে জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান ‘কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড’। এছাড়া, জাহাজটি নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে করা আবেদন পত্রে আয়ুষ্কালের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড। শিপিং কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে লিখিত কোন মতামত না দিয়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডকে বে ওয়ান ক্রুজ চলাচলের অনুমোদন দেয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুধু তাই নয়, আয়ুষ্কালের তথ্য গোপন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে বিলাসবহুল তকমা লাগিয়ে সাগর পথে যাতায়াত করছে বে-ওয়ান ক্রুজ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই গায়ের জোরে সমুদ্রে যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কর্ণফুলী শিপিং ইয়ার্ডের মালিকানাধীন এই প্রমোদতরী নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়-শঙ্কা।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এম এ রশিদ। একুশে পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বে-ওয়ান ক্রুজ নিয়ে সাফাই গেয়েছেন তিনি। জাহাজের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে বেশি হাওয়া ধরে। আর ইঞ্জিনে হাওয়া থাকলে ইঞ্জিন চলবে না। হাওয়াটা বের হয়ে গেলেই ইঞ্জিন চলবে। এমনটাই ঘটেছে বে ওয়ান ক্রুজের সাথে। একটি ইঞ্জিনে হাওয়া জমেছিল। ইঞ্জিন গরম থাকায় সেই হাওয়া বের করতে গিয়েই একটু স্পার্ক হয়েছে৷ আশেপাশে তেল থাকায় সামান্য আগুন লেগেছিল। যা সাথে সাথেই নিভিয়ে ফেলা হয়েছে।’

‘সাড়ে ৫শ’ হর্স পাওয়ারের ২টি ইঞ্জিন ও ৪টি জেনারেটর জাহাজে আছে৷ গণমাধ্যম যেভাবে প্রচার করছে তাতে মনে হচ্ছে জাহাজে কী না কী হয়ে গেছে৷ একটি ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়লেও অপর ইঞ্জিনের মাধ্যমে জাহাজ চলার সক্ষমতা রয়েছে। আর আগুন লাগার পরও একটি মিনিটের জন্যে বাতি নিভেনি। খারাপ কিছু হলে তো জেনারেটরও বন্ধ হয়ে যেত। খুবই সামান্য একটা ঘটনাকে ঢালাওভাবে অপপ্রচার করা হচ্ছে।’

জাহাজটির নিরাপত্তার বিষয়ে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার এম এ রশিদ বলেন, ‘আমরা বাঙালিরা মিছরির চেয়ে তামাক খেতে বেশি পছন্দ করি। আমার জাহাজে ১৮শ’র বেশি লাইফ সেভিং ইকুইপমেন্ট (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, লাইফ জ্যাকেট, বয়া) আছে। জাপানে যেভাবে ছিল আমরাও সেভাবে রেখেছি। আর অবকাঠামোর দিক দিয়েও জাহাজটি বেশ মজবুত। আগামী ২০ বছরেও জাহাজটির কোনো সমস্যা হবে না। বলতে গেলে প্রয়োজনের তুলনায় জাহাজটি অনেক বেশি নিরাপদ, এটা আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি।’

বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে ২৫ বছরের পুরনো জাহাজ সাগরে ভাসানোর ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই আইন শুধু আমাদের দেশে আছে। কোনোদিন শুনেছেন ফাইভ স্টার হোটেল পুরোনো হতে? ঠিক এমনটা জাহাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিদেশে প্যাসেঞ্জার জাহাজ ৭০-৮০ বছরের পুরনো হলেও চলে। প্যাসেঞ্জার জাহাজে সমস্যা হয় না।’ জাহাজটি সমুদ্রে ভাসানোর আগে গত বছর এক সংবাদ সম্মেলনেও একই কথা বলেছিলেন তিনি।

আয়ুষ্কালের তথ্য গোপন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আয়ুষ্কাল লুকানোর তো প্রশ্নই আসে না। এটা তো জাহাজের আইএমও সুইচ চাপলেই বের করা হয়। যত ধরনের অনুমোদন প্রয়োজন- সব নিয়েই আমরা জাহাজটি এনেছি এবং সমুদ্রে চালাচ্ছি। আর অনেকে জানে না যে, ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির অনুমোদন সাপেক্ষে যেকোনো বয়সের জাহাজ আমদানি করা যাবে। এমনটা মন্ত্রীপরিষদে অনুমোদন হয়েছে।’

এ বিষয়ে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘৪ বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া জাহাজটি কীভাবে দেশে এলো? কারা অনুমোদন দিয়েছে? আইনের বিপরীতে যেহেতু জাহাজটি সমুদ্রের ঝুঁকি নিয়ে চলছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যারা বিষয়গুলো দেখে তাদের ম্যানেজ করেই কাজগুলো করা হয়েছে। প্রভাবশালী মহলটি প্রশাসনের চোখকে বন্ধ করে রেখেছে। ফলে সহজেই আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণভাবে নৌ মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রণকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। তাদের যথাযথ নজরদারি থাকলে মেয়াদোত্তীর্ণ এই জাহাজটি আসতেই পারতো না। যে তদারকি ও দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের পালন করার কথা সেটা ঠিকভাবে হচ্ছে না বলেই এমনটা হচ্ছে। এতে করে যাত্রীদের ঝুঁকি বাড়ছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত আমাদের টনক নড়ে না। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা উচিত।’-যোগ করেন তিনি।

এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইতিমধ্যে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌ বাণিজ্য দপ্তর। পুরো জাহাজটি সার্ভে করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। এই কমিটির সদস্যরা হলেন, নৌ বাণিজ্য দপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন শেখ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন গাজী, প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার মো. রফিকুল আলম ও এমভি বে-ওয়ানের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হোসেন।

জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এখানে দেখার প্রয়োজন আছে যে, জাহাজটির অনুমোদন দেওয়ার সময় সকল বিষয় তদারকি করা হয়েছিল কিনা। আপনাদের ধন্যবাদ এসব বিষয় আমাকে জানানোর জন্য। আমার সাথে যখন কথা হবে আমি অবশ্যই এসব নিয়ে আলোচনা করবো এবং অসংগতির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবো।’

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৪ জানুয়ারি কর্ণফুলি শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের মালিকানাধীন প্রমোদতরী ‘বে ওয়ান ক্রুজ’ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ৪৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৫৫ ফুট প্রস্থের জাহাজটির উত্তাল সমুদ্রে চলার সক্ষমতা আছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। ঘণ্টায় ২৪ নটিক্যাল মাইল বেগে চলতে সক্ষম জাহাজটি ২৯ বছর আগে জাপানে তৈরি হয়েছিল।