:: রাজলক্ষ্মী সুবর্ণ রূপা ::
একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড়ো শত্রু তার ‘শরীর’। নিজের ‘শরীর’। একটি মেয়ে হয়ে এই জগতে জন্মাবার সবচেয়ে বড়ো কষ্ট হলো- তাকে সারাক্ষণ শারীরিক অসম্মানের ভয় নিয়ে বড়ো হতে হয়।
একজন পুরুষ, যাকে একজন নারী বিশ্বাস করে মন থেকে- তার কাছেও সেই নারী নিরাপদ নয়। সেই পুরুষের তোলা মুহূর্তের ঝড় তার জীবনটিকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে দিতে পারে।
বিষয়টি অতি ভয়ানক যে কোনো একসময় একটি মেয়ে আবিষ্কার করে যে তাকে কোলে নিয়ে যে চাচা-মামা-খালুশ্রেণীয় ‘ভদ্রলোক’ মুখে ‘মা’ ডেকে পিঠে হাত বোলাচ্ছে, সে হাত বোলানোর মাঝেও আছে ‘অন্যকিছু’। কিন্তু কী সেই ‘অন্যকিছু ’! সেটা বুঝতে বুঝতেই অনেকের অনেকটা দেরি হয়ে যায়…
বিশ্ব যতোই উন্নত হোক- অতি উন্নত দেশে বা আমাদের এই বাংলায় এমন নগণ্য সংখ্যক মেয়েকেই খুঁজে পাওয়া যাবে যারা কখনো না কখনো কোনো না কোনোভাবে তার জীবনে এমন হয়রানির শিকার হয়নি! চলার পথে বাসে, ট্রেনে পাশে বসে থাকা অনাত্মীয় মধ্যবয়স্ক পুরুষটি তাকে সুযোগ পেলেই একটু ছুঁতে চায়। বাড়িতে বেড়াতে আসা আত্মীয় পুরুষটিও তাই-ই চায়। পরম কাছের মানুষটি- সেও সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে হুডতোলা রিক্সার মাঝে চাহনি বদলে ফেলে তাকে ছুঁতে চায়। পরম আস্থার মানুষটিকে গভীর মমতায় একরাশ ভালোবাসা নিয়ে ফাঁকা বাড়িতে ভাত মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার পর সে শরীরের পাগল করা সুবাস পায়, একটু ছুঁতে চায়…; কোনো পুরুষ ভিন্ন তবে??!!! কার আচরণ আলাদা??!!! কাকে বিশ্বাস করে তার বুকে মাথা রেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস নেবে নারী??!!! নারী সত্যিকার অর্থে কার কাছে নিরাপদ??!!!
এই বিষয়গুলিকে ক’জন মেয়েই বা তার আপনজনের সাথে শেয়ার করতে পারে! এমন কি নিজের মায়ের কাছে বলতেও চরম এক আড়ষ্টতা তাকে ঘিরে ধরে। নানান ইশারা-ইঙ্গিতে মেয়েদেরকে তার মাসহ অন্যান্যরা ছোট্টবেলা থেকে এই-ই বোঝায় যে একটি ছেলের সাথে একটি মেয়ের আর যা-ই হোক অন্তত ‘বন্ধুত্ব’ কখনো হতে পারে না। যা হতে পারে তা স্বাভাবিকতার ধার ঘেঁষে হয় না। তাতে পশুত্বই থাকে মুখ্য, থাকে পৌরুষের বিশ্রী প্রদর্শন ; নারীর প্রতি অকৃত্রিম ছেলেখেলার উদাহরণ এ এক!
সমবয়সী দু’ভাইবোন কার্টুন দেখার আনন্দের মুহূর্ত্বে মা-বাবা বাইরে বেরোবার সময় ছেলেটিকে নয়, কেবল মেয়েকে বারণ করে যান- “একা ছাদে যাবে না, একা ছাদ একদমই ভালো না…”
বাল্যকাল থেকে মধ্যবয়স- প্রতিটি মুহূর্ত্বে একজন নারীকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে সে ‘নারী’। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে চলতে চাইবার অধিকার সে রাখে না- সে নারী। সুতরাং কিছু না হোক অন্তত একটি আশঙ্কা আমৃত্যু মনে লালন করতেই হবে তাকে তা হলো তার একটি শরীর রয়েছে।
মেয়েদের শৈশব বলে সত্যিই কি কিছু থাকে…??!!! উহু… থাকে না। শৈশব-কৈশোর-যৌবনÑ নারীর সবটাই তার ‘মেয়েবেলা’ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।
কে যেন বলেছিলেন যে মেয়েদেরকে রোজ সন্ধ্যায় বর্ণমালা শেখার পাশাপাশি শিখতে হয় নীতিমালাও। সমাজের পশুদের হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার নীতিমালা! পুরুষকে অবিশ্বাস করার নীতিমালা। হাজার ‘ভালো’র মাঝে তার জীবন অন্ধকার করে দেওয়ার মতো কোনো ‘কালো’ রয়ে যাচ্ছে কিনা তা খুঁজে দেখার নীতিমালা!
এক নারীজন্ম- কেবল এক ভয়েই কেটে যায়। একটাই ভয়। সত্যি বলতে নারীর আর কিসে ভয়! আমার তো চোখে পড়ে না! সে যে ‘নারী’- এটা সে ভুলতে পারে না। কেউ ভুলেও তা ভুলতেও দেয় না। সে যে ‘নারী’ হয়ে জন্মেছে এ ভয়েই নারীর নারীজন্ম কেটে যায়।
এ ভয়টা শুধু তার মেয়েবেলাকেই নয়; নষ্ট করে তার গোটা অতুল জীবন। যে জীবনে হাজারো সম্ভাবনা ছিল। …নারী-পুরুষের সম্পর্কগুলি সত্যিই যদি নিপাট শুদ্ধ হতো! বড়ো ভালো হতো তবে। সম্পর্কের কুৎসিত অংশগুলি বড্ড সাংঘাতিক। বড্ড কুটিল… বড়ো বেশি যন্ত্রণাদায়ক।