ওবায়দুল করিম দুলাল : নেতৃত্ব জন্মায়, সামাজিক সম্পর্ক থেকে। নেতৃত্ব, দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, সমাজের অপরিহার্য শর্ত। খাদ্য সংগ্রহ বা উৎপাদন কোনটাই নেতৃত্ব ছাড়া হয়না। সমাজের অনুষঙ্গী সমস্ত দল, সংগঠনে নেতৃত্ব থাকে। পরিবারে পিতা বা মাতা, স্কুল- কলেজে প্রধান শিক্ষক বা প্রিন্সিপ্যাল, সরকারে প্রধান মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র, বিপুল জনগোষ্ঠীর সমাবেশ যেখানে স্তরায়িত প্রশাসনের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবন পরিচালিত হয়। আর নেতৃত্ব এখানে অপরিহার্য। প্রাচীনকালে ও ক্ল্যান বা গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধতার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল। নেতৃত্বহীন সমাজ কখনোই ছিলনা বরং বলা যায়, সমাজ আর সভ্যতার বিকাশ নেতৃত্ব ছাড়া হয় না।
নেতৃত্বের বড় গুণ মেধা ও মোটিভেট করবার সামর্থ্য। সাথে অবশ্যই ধৈর্য্য, অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা বোধ থাকা ইত্যাদি আচরণগত বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। তবে সামাজিক পরিবর্তনের সাথে নেতৃত্বের ধারণা ও পাল্টায়। রাজতন্ত্রে নেতৃত্ব আদেশমূলক। গণতন্ত্রে তা হয় প্রতিনিধিত্বশীল। ফলে প্রতিনিধিত্বশীল সমাজে নেতৃত্বকে, বহু গুনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়। বিশেষ করে, জনমতের তোয়াক্কা করা ও জনগণকে মোটিভেট করবার যোগ্যতা থাকা। প্রাণিদেহ যেমন লক্ষ কোষের সমস্টি, সমাজদেহ ও তাই। স্তরায়ন ভিত্তিক প্রশাসন হচ্ছে এমনই কোষ। এই প্রশাসনের দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য চাই দক্ষ নেতৃত্ব। আর প্রতিনিধিত্বের সমাজে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে উঠে নেতৃত্ব। এমনই এক নেতৃত্বের নাম রেহানা বেগম রানু।
প্রত্যেক মানুষেরই আবেগ, অনুভূতি আর চিন্তার কাঠামোর সৃষ্টি একেবারেই সম্পূর্ণ নিজস্ব। এগুলোর গঠন,সমাজের প্রেক্ষাপট তথা সামাজিক সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত। বলে থাকি, রবীন্দ্রনাথ এখন জন্ম নিলে, ‘গোরা’, ‘ঘরে বাইরে’ লিখতে পারতেন না, কারণ সেই সামাজিক প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। হয়তো আরো মহৎ কিছু লিখতেন কিন্তু উল্লিখিত উপন্যাস লিখতে পারতেন না। মানুষের জন্ম-মৃত্যু, কোনও ব্যক্তির তিরোধানে এজন্যই উল্লেখ করা হয়। তো আমাদের, জনপ্রতিনিধির, আবেগ, অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার বর্ণনা অবশ্যই সামাজিক সম্পর্ক থেকে উঠে আসবে। মানুষের চিন্তা, অভিজ্ঞতা যেমন, সামাজিক সম্পর্কজাত, ঠিক আবার সামাজিক সম্পর্কের আদল দিতে ব্যক্তির নেতৃত্ব, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভূমিকাও উল্লেখ্য।
সব মানুষেরই সামাজিক পরিচিতি আছে। এবং পরিচিতি দেয়ার সাথে সাথে ঐ ব্যক্তিকে, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়।সমাজবিজ্ঞানে একে রোল বা ভূমিকা বলা হয়। তো জনপ্রতিনিধি রেহানা বেগম রানুও মা, সন্তান ও গৃহিণী। তাঁর সব পরিচিতির ভূমিকা পালনের সাথে সাথে, জনপ্রতিনিধি হিসেবেও ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠা ও তাঁর বিরুদ্ধ প্রতিবেশ সম্পর্কে জানান দেয়া, সামাজিক অবস্থানকে নির্দেশ করে, যা সামাজিক গবেষণায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। বলা হয়, মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব তাঁর সামাজিক চেতনাকে নির্মাণ করে, আবার সামাজিক চেতনা ও সামাজিক অস্তিত্বকে প্রভাবান্বিত করে। লেখিকা রেহানার, মা, গৃহিণী থেকে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর বা জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠার ও তার বর্ণনায় সামাজিক পরিস্থিতির চিত্রায়নটা প্রকাশিত হয়। লেখিকার নিজের অনুভূতি, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিজ্ঞতা সমাজ থেকে পাওয়া। সামাজিক সম্পর্কের বাইরে থাকলে, এসব অনুভূতি বা চেতনা মানুষের থাকে না। রেহানা বেগম রানুর ও তাই। তিনি সামাজিক পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর অন্যদের মোটিভেট করবার ক্ষমতা দিয়ে।
তবে নেতৃত্বের অধিকারী যাঁরা, তাঁরা মানবিক ও নেতৃত্বের গুণাবলীর জন্য লক্ষ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেন। জনপ্রতিনিধি,সামাজিক যোগাযোগের সফল প্রযোগের ফলেই জনপ্রতিনিধি হন। তাঁর যোগাযোগ উলম্বী (Vertical) ও সমান্তরাল (Horizontal)। এর অর্থ সামাজিক স্তরায়িত সমাজের সকল পেশা ও স্তরের মানুষের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন ও তাঁদের আকাঙ্খার বাস্তবায়নের অংশীদার হওয়া। এছাড়া নারীদের অধস্তন অবস্থা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা ও উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়তো আছেই। দিনকালের ঘটনা যা আমরা অবলোকন করি, তার লেখায় বর্ণনই তো ডায়েরি। ডায়েরি শুধু নিজের জীবনের ঘটনার বর্ণনাই নয়, তা প্রজন্মকে মোটিভেট করবার উপায়ও বটে। সার্থকভাবে কাজটি তিনি করতে পেরেছেন।
রানুর জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠার শুরুটা চমৎকার। গান গেয়ে নমিনেশন! গুণধারীর গুণবিচার গানে শুরু হলেও পরিচিতির শেষ অধ্যায়ে দেখি জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠায়। না এতেও কি শেষ? রাজনীতির দোলাচল বড়ই অদ্ভুত। রেহানা বেগম রানুর বর্ণনায় তা পরিস্ফুটিত। বিশেষ করে সংরক্ষিত মহিলা আসনে, তাঁর নমিনেশনকে কেন্দ্র করে। জনপ্রতিনিধি হয়েও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের কাজে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া, ইত্যাদির বর্ণনা আছে তাঁর ডায়েরিতে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তাঁর ভূমিকার বর্ণনাও আছে।
জনপ্রতিনিধিত্বের জন্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। একজন আইনজ্ঞ ও শিক্ষিত মহিলা হিসেবে, রাজনীতির ভেতরের ও বাইরের প্রতিপার্শ্বের বর্ণনা, যা রাজনীতির বাইরের দর্শকদের অজানা তাও নির্দ্বিধায় বর্ণনা করেছেন রানু। একজন মহিলার, জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠা যে এক বিশাল সংগ্রাম, আত্মত্যাগ আর তিতিক্ষার ব্যাপার, তা হয়তো জানা হতো না এই লেখনীর প্রকাশ না পেলে। রাজনীতির অ আ ক খ, শুধু আদর্শ নয়, ব্যক্তি সংঘাত, ও সংগ্রামের যে একটা চিত্র আছে তা ও বোধে আসে, রানুর এই ডায়েরি পাঠে। আর হ্যাঁ, আমরা যাঁরা, পাঠক ও জনগণ, তাঁদের রাজনীতির গ্রীণরুমের ঘটনাবলিও জানা হতে পারে এই ডায়েরি পাঠে।
তাঁর ‘জনপ্রতিনিধির ডায়েরি’তে লেখন আছে ৬২টি। ডায়েরি কোন গল্প লেখন নয়। ফলে বর্ণনা বা লেখনের বিস্তৃতি, সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। মাত্র ২৬৪ পৃষ্ঠার বইতে এই লেখাগুলো যথেষ্ট। ‘শুরুর কথায়’ রয়েছে লেখনীর অবয়ব নির্মাণের পটভূমি। ছবি, কোন লেখাকে প্রমাণসিদ্ধ করবার জন্য দলিল অথবা স্মৃতি বা ইতিহাসের উৎস নির্মাণে প্রয়োজন। রেহানা বেগম রানু, এই কাজটি করেছেন যথাযথভাবে। ১৯৭ পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা অব্দি, ছবির সংকলন আছে, যা ডায়েরিতে বলা কথার চেয়েও মজবুত ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে।
প্রচ্ছদ খড়িমাটি’র। খড়িমাটির, অন্যান্য প্রকাশনার প্রচ্ছদের মত এইটি ও দৃষ্টিনন্দন। মুদ্রণে, নিউগ্রাফ প্রিন্টার্স। বইয়ের ছাপা, বেশ সুন্দর। কাগজের মান ও ভালো। প্রকাশনায়, বর্ণনা প্রকাশন। পরিবেশনায় খড়িমাটি। গ্রন্থস্বত্ব, লেখিকা রেহানা বেগম রানু’র। বইটি লেখিকা, জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করেছেন। টাকায় ডায়েরির মূল্য, ৳৫১০ মাত্র। মার্কিন মুদ্রায় $৭ মাত্র। ISBN কোড নাম্বার আছে তবে বইয়ের শেষে দেয়া বারকোড স্ক্যান করে চীনা ভাষায় কিছু লেখা দৃষ্টিতে আসলেও তা যে বইয়ের সাথে যোগ নেই তা বোঝা যায়। কারণ, বারকোড মূলত বইয়ের তথ্য ধারণ করে। প্রকাশককে এই বিষয়টি ভবিষ্যতে খেয়াল রাখতে হবে। বইয়ের জ্যাকেটের প্রথমে, ভূমি বোর্ডের সচিব ও চেয়ারম্যান জনাব মো. আব্দুল মান্নান এর ছোট্ট একটি পরিচিতির লেখনী আছে, লেখিকা রেহানা বেগম রানুকে নিয়ে, যা ডায়েরির লেখিকা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। জ্যাকেটের শেষে, ডায়েরি রচয়িতার পরিচিতির মাত্রাকে বিস্তৃত করে। এমন পাঠ, নির্দিষ্ট কালের উপাদেয় স্বাক্ষী হয়ে থাকে। কাল বা সময়, রেহানা বেগম রানুর এই লেখাকে ইতিহাসের আকর হিসেবে দেখুক, এই কাম্য।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।