অধ্যাপক (অব.) ডা. মো. আব্দুল জলিল চৌধুরী : পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস কখন বিদায় নেবে- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে পৃথিবীতে করোনাভাইরাস এসেছে কেমন করে? প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল চীনের উহান প্রদেশের কোন এক ল্যাব থেকে এই মরণঘাতী ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল। সেটা কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু সে বিষয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে।
পরবর্তীতে অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, পরিবেশ ধ্বংসের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ও বিকাশ। কোন কোন বিজ্ঞানীর ধারণা, চীনের পশুপাখির মার্কেট থেকে কোন প্রাণী হতে প্রথমে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ায়।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে বহু মহামারী এসেছে। বহু মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে আবার বিদায় হয়েছে। বিভিন্ন মহামারী আসার পিছনে ভিন্ন ভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বিদায় করার ব্যাপারে টিকা যে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃথিবী থেকে প্লেগ, গুটি বসন্তের বিদায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।
পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত আদ্, সামুদ, নুহ জাতির ধ্বংসের কথা আমরা জানি। উল্লেখিত জাতিগুলো যখন এক সত্য উপাস্য আল্লাহকে ভুলে গিয়ে শিরকে লিপ্ত হয়, বিভিন্ন পাপাচারের ডুবে যায়, তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন নবী-রাসূল প্রেরণ করেন। কিন্তু জাতিগুলোর চরম অবাধ্যতার কারণে আল্লাহর তরফ থেকে আযাব এসে জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। সেখানে নতুন জাতি সৃষ্টি হয়।
মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত হতে থাকে তখন তাদেরকে হুঁশিয়ার করার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে আজাব-গজব আসা বিচিত্র কিছু নয়। আমাদের শেষ নবীর দোয়ার বরকতে উম্মতে মোহাম্মাদীর কোন জাতি আর আগের মত আমুলে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা নয়।
গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকা যখন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা করে তখন প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারায়। জাপান আত্মসমর্পণ করায় বোমা ফেলা বন্ধ হয় এবং বিশ্বযুদ্ধের করুণ পরিসমাপ্তি হয়।
আমরা কি ভাবতে পারি না এই করোনা মহামারীটাও মানুষের পাপের ফলে আল্লাহর তরফ থেকে আমাদেরকে সাবধান করার জন্য এক ধরনের আজাব? তাহলে আমরা কি আসলেই সাবধান হয়েছি? এই করোনা মহামারীর সময়ও বহু দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি চিকিৎসা সামগ্রী, জীবন রক্ষাকারী ঔষধের কেনাকাটা নিয়েও দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় ধর্ষণের খবর বের হচ্ছে। হত্যা রাহাজানি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কি আমাদের কৃতকর্মের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি যে তিনি আমাদের উপর থেকে তার গজব উঠিয়ে নিবেন?
করোনা মোকাবেলায় যেসব বিধিনিষেধগুলো মানার কথা সেগুলো কি আমরা ঠিকমত মানছি? সরকারি আদেশ (যদি না সেটা কুফরি আদেশ হয়) মানা একজন মুমিনের কর্তব্য। আমরা মসজিদে নামাজ পড়তে যাই, কিন্তু অধিকাংশই মাস্ক পরেন না। সঠিকভাবে হাত ধোয়ার, দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড়ানোর বালাই নেই। এ ব্যাপারে মুসুল্লিদের উৎসাহিত করতে অনেক জায়গায় অনিহা দেখা যায়।
বুখারী শরীফের একটি হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত ওমর (রা.) তার খেলাফতের সময় একবার মদিনা থেকে সিরিয়ার উদ্দেশ যাত্রা করেছিলেন, পথিমধ্যে “সারাগ” নামক এক জায়গায় পৌঁছালে তাকে অবহিত করা হয় যে, সিরিয়া এলাকায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তখন সেখানে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারে উপস্থিত সাহাবাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
এমন সময় একজন প্রবীণ সাহাবা উপস্থিত হয়ে জানান যে, নবী করিম (সা.) বলেছেন “যখন তোমরা কোন এলাকায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব এর সংবাদ শুনো, তখন সে এলাকায় প্রবেশ করবে না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর তথায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না।” এই হাদিস শুনে হজরত ওমর (রা.) আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং অতঃপর মদিনায় ফিরে যান।
তাহলে দেখুন এই করোনা মহামারীর সময় আমরা কি তার প্রতিরোধের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যেসব বিধিনিষেধ সরকার জারি করেছে সেগুলা ঠিকমত মানছি, আমরা কি কোরআন হাদিস মানছি? আমরা কি আল্লাহর কাছে কায়মনবাক্যে আমাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি? সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, টিকা নিয়ে ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করছি? যদি এসব কিছু ঠিকমতো করি, নিশ্চয়ই করোনা বিদায় হবে। আর যদি না করি তবে আল্লাহই ভালো জানেন।
লেখক : প্রাক্তন চেয়ারম্যান, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।