রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

দেবতা অসন্তুষ্ট হবে তাই অনেক কিছুই বারণ, আহা নারী!

প্রকাশিতঃ ৪ জুলাই ২০২১ | ১১:২৭ পূর্বাহ্ন

শান্তনু চৌধুরী : পুরুষদের যে কোনো বিষয় নিয়ে সহজেই যে আড্ডাটা হয়, নারী নিয়ে সে বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যেন বিষম খান। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের সাথেও আলোচনা উঠল, দেখলাম আড়ষ্ঠতা কাটেনি। দোকানে যখন প্যাড, পিল বা কনডম কিনতে যাই কখনো আমি প্যাক করে দিতে বলি না। প্রায় সময় দেখি দোকানি তার টেবিলের নিচে এমনভাবে এসব জিনিস প্যাকেটে ঢোকাচ্ছেন যেন নিষিদ্ধ বা গোপন কিছু দিচ্ছেন। কেউ দেখলেই সর্বনাশ হবে। অথচ অন্য ওষুধ বা অন্য সামগ্রীর বেলায় তিনি তা করছেন না।

আবার দেখি, নারীরা যখন অর্ন্তবাস শুকাতে দেন খুব গোপনে অন্য কাপড়ের নিচে লুকিয়ে রাখেন। যখনই আলোচনার সুযোগ হয়েছে বলেছি, এসবতো নিষিদ্ধ বা লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়। অন্যান্য কাপড়ের মতো জাস্ট পরিধানের কাপড় মাত্র। এগুলো বরং ভেজা থাকলেই শারীরিক সমস্যা হতে পারে। কথাগুলো এই কারণে বলা, ট্যাবু ভাঙতে হবে। আর সেই কাজটা করতে হবে তারুণ্যকে।

আপনাদের নিশ্চয় ভারতের উষশী চক্রবর্তীর কথা মনে আছে। যিনি প্রথা ভেঙে ঋতুমতী অবস্থায় পুজো করেছিলেন। শুনুন তাহলে তার গল্পটা। হিন্দু ধর্মে যুগ যুগ ধরে এই ধারণা আছে, মাসের যে ক’দিন কোনও নারী ঋতুমতী থাকবেন, সেই কদিন তিনি পুজো বা কোনোরকম ধর্মীয় কাজে অংশ নিতে পারবেন না, মন্দিরে যেতে পারবেন না। কলকাতার এক কলেজ ছাত্রী উষশী তার বাড়িতে সরস্বতী পুজো করে সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছেন। তার সঙ্গে তিনি এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে পুজোর দিন তিনি ঋতুমতী ছিলেন। যথারীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা নিয়ে তোলপাড়। অনেকেই যেমন মন্তব্য করছেন যে অত্যন্ত সাহসী এবং সময়োাপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি, তেমনই বদনামও করা হচ্ছে তাকে। উষশী চক্রবর্তী নামের ২৩ বছর বয়সী ওই ছাত্রীকে নেট-নাগরিকদের যে একাংশ ‘ট্রল’ করছেন, তাদের বক্তব্য দুটি এরকম- এক, তিনি নারী হয়ে কী করে পুজো করলেন। দ্বিতীয়ত, রজঃস্বলা অবস্থায় পুজো করা তো ঘোর পাপ, একেবারে অনর্থ হয়ে যাবে, এমনকি সুনামি বা ভূমিকম্পও হয়ে যেতে পারে এই অনাচারের জন্য।

পিরিয়ডের সময় গ্রামের ভেতর ছোট এককক্ষের যে ঘরে এখনও অল্পবয়সী সব মেয়েদের রাত কাটে এসব ঘর সাধারণত মাটির। ঘরে প্রবেশের দরজা এতই ছোট যে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। কোনো কপাট নেই। এই ঘর শীতের সময় একটি মশারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। তবে অন্যসময় খোলাই থাকে। রাতে স্থানীয় নিরাপত্তাকর্মীরা টহল দেয় আর কুকুর ঘোরাফেরা করে। শহরাঞ্চলে এখন মেয়েদের কাছে স্যানিটারি প্যাড পরিচিত হলেও, এখানকার মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। স্যানিটারি প্যাড কেনার মত টাকা তাদের হাতে নেই। আবার জলের কল ব্যবহার করার অনুমতি নেই তাদের, কারণ দেবতা অসন্তুষ্ট হবে, এমনটাই মনে করা হয়। এমন উদাহরণ বিভিন্ন দেশে রয়েছে।

বিবিসিকে শাস্ত্রবিশারদ নবকুমার ভট্টাচার্য বলছেন, ‘কে বলেছে মেয়েরা পুজো করতে পারবে না? এটা একেবারেই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু সেটা নিজের বাড়ির পুজো হতে হবে’। উষশী চক্রবর্তী কেন এই কাজ করলেন। তাঁর মতে, ‘ভেবেচিন্তেই এই প্রথা ভেঙেছি। পিরিয়ড হয়েছে এই কথাটা বলতে আমাকে যেন লজ্জা না পেতে হয়, স্যানিটারি প্যাড যেন লুকিয়ে কিনতে না হয় বা জামার পিছনে রক্তের দাগ লেগে গেলে যেন আমাকে লজ্জায় মুখ লুকোতে না হয়। কেন আমাকে কাগজের মোড়কে বা কালো প্ল­াস্টিকে মুড়ে স্যানিটারি প্যাড কিনতে হবে! এই কথাগুলো আমার এবং আমার পরের প্রজন্মের মেয়েদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি বলেই প্রথাটা ভেঙেছি। যে কথাটা মেয়েদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বুঝিয়ে আসা হয়েছে, সেটা যে ভুল, সেটাই বলতে চেয়েছি জোর গলায় বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন মিস চক্রবর্তী।

নেপালে ঋতুস্রাবকে ঘিরে নানা রকম রক্ষণশীলতা এবং সামাজিক রাখঢাক এখনো রয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ঋতু¯্রাবের মত একটি শারীরিক প্রক্রিয়া চলার সময় মেয়েদেরকে মনে করা হয় অপবিত্র। এই প্রথাকে বলা হয় ছাউপাদি। ২০০৫ সাল থেকে এই ধরনের কর্মকা-কে বেআইনি ঘোষণা করা হলেও, এখনো অনেক সমাজে তা প্রচলিত। নেপালের পশ্চিম এলাকার বাড়িগুলো মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি। এখানকার গ্রামগুলোর প্রায় সব পরিবারই ছাউপাদি প্রথা পালন করে। পিরিয়ড বা মাসিক শুরু হলে চার থেকে ৬ দিন তাদের বাড়ি থেকে দূরে একটি ঘরে রাখা হয়। যেন একরকম সাময়িক নির্বাসন। একই কাপড় পরে চারদিন ধরে কাটাতে হয়। ওই সময় কোনও পুরুষকে স্পর্শ করা যাবে না এবং বিশেষ কিছু খাবার খেতেও বারণ। এরপর ৬ষ্ঠ বা ৭ম দিনে গরুর মূত্র দিয়ে গায়ে ছিটিয়ে তাদের ঘরে তোলা হয়।

এতে অপবিত্রতা দূর হল বলে মনে করেন স্থানীয়রা। তবে এখন অনেকে এই প্রথা ভাঙার চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্য-কর্মীদের আশঙ্কা, এই বিশেষ সময়টিতে বাড়ি থেকে দূরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে একা দিন-রাত অবস্থান, বিশুদ্ধ পানির অভাব মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে মেয়েদের জন্য। তারা দরজায় দরজায় গিয়ে অনুরোধ করে বলছেন আপনার মেয়েকে বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য করবেন না। তাদেরকে এসময়টায় ঘরের ভেতর থাকতে দিন। কিন্তু এটা খুবই কঠিন কাজ। লোকজন আমাদের ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। অভিশাপও দেয়। বেশিরভাগ সময় পুলিশ সাথে নিয়ে গ্রামগুলোতে ঢুকতে হয়।

পিরিয়ডের সময় গ্রামের ভেতর ছোট এককক্ষের যে ঘরে এখনও অল্পবয়সী সব মেয়েদের রাত কাটে এসব ঘর সাধারণত মাটির। ঘরে প্রবেশের দরজা এতই ছোট যে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। কোনো কপাট নেই। এই ঘর শীতের সময় একটি মশারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। তবে অন্যসময় খোলাই থাকে। রাতে স্থানীয় নিরাপত্তাকর্মীরা টহল দেয় আর কুকুর ঘোরাফেরা করে। শহরাঞ্চলে এখন মেয়েদের কাছে স্যানিটারি প্যাড পরিচিত হলেও, এখানকার মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। স্যানিটারি প্যাড কেনার মত টাকা তাদের হাতে নেই। আবার জলের কল ব্যবহার করার অনুমতি নেই তাদের, কারণ দেবতা অসন্তুষ্ট হবে, এমনটাই মনে করা হয়। এমন উদাহরণ বিভিন্ন দেশে রয়েছে।

আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হলেও এখনো গ্রামাঞ্চলগুলোতো এসব নিয়ে নানা সংস্কার রয়েছে। তবে একথা ঠিক যে শহুরে মানুষজন বা শিক্ষিতরা এসব বিষয়ে আগের চেয়ে সচেতন হয়েছেন। আবার পিরিয়ডের সময়ে বা নিরাপদ গর্ভধারণ বা নারীর স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সক্রিয় থাকার ফলে প্রাচীন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছেন অনেক নারী। আবার সচেতন থাকার কারণে কমছে মৃত্যুহারও।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক