রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

হঠাৎ সিগন্যালে প্রেম আটকে গেল

প্রকাশিতঃ ৩০ মে ২০২১ | ১:২৭ অপরাহ্ন

শান্তনু চৌধুরী : ইউটিউবে রূপঙ্কর বাগচীর গান শুনছিলাম। প্রিয়তমাকে ‘ও চাঁদ’ সম্বোধন করে। কতো আশা ছিল একসাথে ভদকা খাওয়ার, বেড়াতে যাওয়ার এমন সব। শেষ পর্যন্ত হারাতে হলো চাঁদকে। শেষ লাইনটি বেশ চমৎকার। ‘ও চাঁদ, তোর এম বি বি এস বরের পাশে, গ্রুপ ফটোতে ব্রাদার সেজেই থাকতে হলো’। প্রিয়াকে চাঁদের সাথে তুলনা করার রীতি বেশ পুরনো। তবে আপনি যদি কখনো নির্জন সৈকতে, বিস্তীর্ণ মাঠে বা পাহাড়ের অনেক উঁচুতে, নিদেনপক্ষে বাসার ছাদে উঠেও নিস্পলক চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন তাহলে এক অন্যরকম অনুভূতি হবে।

এমন এক জোছনায় ঘর থেকে বাহিরে যেতে মন ছটফট করবে। নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ যেটিকে বলেছেন গৃহত্যাগী জোছনা। যে জোছনা দেখে সিদ্ধার্থ ঘর ছেড়েছিলেন। কিন্তু চাঁদের এই রূপকে প্রথমে কবিতায় যিনি আঘাত করেছিলেন তিনি বোধহয় সুকান্ত ভট্টাচার্য। বলেছিলেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। আসলে প্রথা ভাঙার যে কোনো কিছুই আলোড়ন তুলে। এই যেমন ভারতের স্নেহার উদাহরণ দেই। তিনি নিজেকে শুধু ভারতীয় নাগরিক মানেন; কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা বর্ণের মানুষ নন। তামিলনাড়ু সরকারের কাছ থেকে ধর্ম ও বর্ণহীন নাগরিক হিসেবে সনদ আদায় করে নিজের বিশ্বাসের আইনি বৈধতা পেয়েছেন ৩৫ বছরের নারী এম এ স্নেহা। তিরুপাথুরের এই আইনজীবীর নামের সঙ্গে কোনো বর্ণ পরিচয় নেই।

এমনকি তার জন্মসনদ বা স্কুলের সনদেও বর্ণ পরিচর ও ধর্ম পরিচয় লেখার ঘর ফাঁকা। সম্প্রতি তামিলনাড়ু সরকার স্নেহার নামে একটি আনুষ্ঠানিক সনদ পাঠিয়েছে। যেখানে তাকে বর্ণ ও ধর্মহীন নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতে তিনিই প্রথম এ ধরনের সনদ পেলেন বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। বিশ্বাস করুন, আমাদের অনেক ফর্ম এ ধর্মের ঘরও আমি ফাঁকা রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে মেনে নেয়ার মানসিকতা, তাই ক্ষীণ প্রতিবাদেই থেমে যাই। কী দরকার ঝামেলা করে! আবারো ফিরে যাই চাঁদ প্রসঙ্গে, চাঁদের দিকে আমরা অনেকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু জানেনতো চাঁদের একটা অংশের নাম হাইপেশিয়া।

যারা হাইপেশিয়ার নাম একেবারেই শোনেননি তাদের বলছি- ৪১৭ খ্রিস্টাব্দে কিছু ধর্মান্ধ মানুষ হাইপেশিয়া নামের অসম সাহসী নারী বিজ্ঞানীটিকে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি থেকে লেকচার শেষে ফেরার পথে তার ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে বিবস্ত্র করে কুটিকুটি করে কেটে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল! হাইপেশিয়ার মৃত্যুর সাথে সাথেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পৃথিবী বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি আর শত শত বিজ্ঞানীর রাতদিনের কাজ।

হাইপেশিয়ার অপরাধ ছিল একটাই- মানুষকে মুক্তচিন্তার পাঠ দেওয়া! গণিত বিজ্ঞান এবং দর্শনে তিনি এতোটাই অসাধারণ ছিলেন যে তার মৃত্যুর পরের এক হাজার বছরকে বলা হয়- বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্ধকার যুগ! যতদিন না নিউটন, কেপলার, কপারনিকাসেরা এসে উদ্ধার করেছেন বিজ্ঞানকে। কয়েক বছর আগে নাসা পৃথিবীর মহান এই দার্শনিক বিজ্ঞানীকে সম্মান জানিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠের একটা অংশের নাম দিয়েছে- হাইপেশিয়া! সেকালেও ধর্মান্ধ ছিল…একালেও আছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মেঘলা হয়ে আছে আকাশ। ঘনঘোর বরিষা আর করোনার চোখ রাঙানি ঘরের বাইরে যেতে মানা করলেও নষ্টালজিক হয়ে যাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে তেমন কিছু নষ্টালজিক বিষয় তুলে ধরছি। যখন আমরা ছোট ছিলাম, হাতগুলো জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বলতাম, আমার হাত নেই, একটা পেন ছিল, যার চার রকম কালি, আর আমরা তার চারটে বোতাম একসাথে টেপার চেষ্টা করতাম। দরজার পিছনে লুকিয়ে থাকতাম কেউ এলে চমকে দেব বলে, সে আসতে দেরি করছে বলে অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে আসতাম। ভাবতাম আমি যেখানে যাচ্ছি, চাঁদটা ও আমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। সুইচের দুদিকে আঙুল চেপে অন্-অফ এর মাঝামাঝি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করতাম। দু-ফোটা জল ফেলে রেস করাতাম, কোনটা গড়িয়ে আগে নীচে পড়ে। বৃষ্টি হলে ছাতা না নিয়ে কচু বা কলাপাতা মাথায় দিয়ে বলতাম, দ্যাখ জল গায়ে লাগছে না।

তখন আমাদের শুধু একটা জিনিসের খেয়াল রাখার দায়িত্ব ছিল, সেটা হল স্কুলব্যাগ। ফলের দানা খেয়ে ফেললে দুশ্চিন্তা করতাম, পেটের মধ্যে এবার গাছ হবে। ঘরের মধ্যে ছুটে যেতাম, তারপর কী দরকার ভুলে যেতাম, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর মনে পড়ত। এমন কতো কী। সময় বদলে যায়। সবাই মত্যুর দিকে এক ধাপ এক ধাপ করে এগিয়ে যায়। হয়তো ফেসবুকে পাওয়া সেই কথামালার মতো, মিনা কার্টুনের মিনারও আজ বিয়ে হয়ে গেছে সেও আজ ঘর-সংসার সামলাতে ব্যস্ত। টম আর জেরিতো এখন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছে। মিস্টার বিন এখন ব্যস্ত হলিউড নিয়ে।

সিসিমপুরের ইকরি, সিকু, হালুম, টুকটুকিও আজ ভার্সিটিতে পড়ে। ‘ইত্যাদি’ তেও আজ রসকস নেই। বুস্ট কিনলে আজ ব্যাট ফ্রি দেয় না। চিপসের প্যাকেটের সাথেও আজ স্টিকার, খেলনা, সৈন্য ফ্রি দেয় না। নোকিয়া ফোনের সাপটাও আজ বুড়ো হতে হতে মৃত প্রায়। বাকি রইল কেবল ঈদ, পুজো বা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান। সেগুলোও আজ মৃতপ্রায়। তেমন আর আনন্দ নেই। স্মৃতির পাতায় আজ ধূসর শৈশব। ছোটবেলায় ভাবতাম কবে বড়হবো। আজ বড় হয়ে ভাবছি, সেই ছোটবেলাটা যদি আরেকটি বার ফিরে পেতাম। কিন্তু কবিতো বলেছেনই, ‘আমরা জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি’।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক