শান্তনু চৌধুরী : এখন প্রতিদিন বিকেল হলেই সন্ধ্যা নামার আগে যে নাম ধরে ডাকাডাকি হয়, সেটি ছোলা মুড়ি বুট পেঁয়াজু। এখন ছোলা পেঁয়াজু মুড়ি মাখানোর মাস। অন্তর্জাল ঘাটতে ঘাটতে বেশ চমকপদ এক তথ্য পাওয়া গেল। এই যে আয়েশ করে ছোলা মুড়ি খাচ্ছি তাও নাকি এদেশি সংস্কৃতি নয়।
আফগানদের প্রিয় খাবার কাবুলি চানা বা কাবুলি ছোলা। সেখান থেকে এই জিনিস নিয়ে এলেন ভারতের মুসলমানেরা। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের বাংলাদেশে। তবে কাবুলিওয়ালারাতো এখন আর ঘুরে ঘুরে কাবুলি ছোলা বিক্রি করছে না। তাই আমরা খাই দেশি ছোলা। আমাদের এই ছোলাভুনার সাথে কাবুলি চানার মিল কিন্তু সামান্যই। দেশিয় নানা মশলা আর পেঁয়াজের মিশ্রণে আমাদের ছোলাভুনার স্বাদই অন্যরকম। এর সঙ্গে আরো বড় ব্যবধান নিয়ে এসেছে মুড়ি।
আফগানরা কিন্তু কখনোই ছোলার সাথে মুড়ি খান না। কিন্তু আমাদের যেন মুড়ি ও ছোলার সাথে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক আছে। সুযোগ পেলেই তারা মিশে যায়! শরবতের সময় যে বুটের হালুয়া তৈরি করা হয় সেটার আসল নাম হাবশি হালুয়া। এটাও কিন্তু আফগানদের খাবার। বিভিন্ন সময়ে এই উপমহাদেশে আসা এবং শাসন করা নানা জাতি গোষ্ঠীর নানা ধরনের সংস্কৃতির মতো খাবারও এখন এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় মিশে গেছে। সেভাবেই ইফতারের এই খাবারের তালিকায় ছাপ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশের খাবার-সংস্কৃতির।
ইফতারে যেসব খাবার খাওয়া হয়, তার বড় অংশটি এসেছে পার্সিয়ান বা মুঘল খাবারের তালিকা থেকে। এক সময় মুঘলরা ভারতবর্ষ শাসন করতো। তারা যখন ঢাকা শাসন করেছেন, তাদের সেই খাদ্যতালিকা তখনকার ঢাকার লোকজন গ্রহণ করেছে। এরপর আস্তে আস্তে সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামের শেষ নবী ইফতারের সময় খেজুর, মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। ফলে ইফতারের সময় খেজুর খাওয়াকে সুন্নত বলে মনে করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই রীতিটি সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বেই ইফতারের সময় খেজুর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ বলে মনে করা হয়। প্রসঙ্গত পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ এই তিনটি খাবার উত্তর ভারত থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন এলাকার খাবারে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এবার বাঙালিরা মুড়ি ও জিলাপী নিয়ে যা করেছে তা রীতিমতো বিস্ময়! মুড়ির দাম বাড়িয়ে সেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ম্যাড়ি’। কেজি ১২শ’ টাকা। আর জিলাপি হয়ে গেছে ‘জালেবি’। দাম ২২শ’ টাকা।
এ প্রসঙ্গে নেট থেকে পাওয়া সুদানের বাহারি নামের ইফতারের কথা মনে পড়লো। আমাদের দেশে ইফতারের আগে আগে সবারই বাসায় ফেরার তাড়া থাকে। আর সুদানে সবাই ছোটেন খোলা মাঠে। সেটাই সেখানকার ঐতিহ্য। সুদানিদের প্রিয় ইফতার হলো মাংসের কাবাব। নাম, ‘মূলাহ ওয়াইকা, মুলাহ রক’। এই জিনিস খেতে হয় ‘কিসরা’ নামের এক প্রকার রুটি দিয়ে। সাথে থাকে শসা আর টক দইয়ের সালাদ ‘সালাতেত জাবাদি’। এছাড়া মরক্কোর ‘হারিরা’ স্যুপও খান তারা ইফতারিতে। খাবার শেষে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো সুদানিদের বিখ্যাত ‘জাবানা কফি’। প্রতিটা দেশেই ইফতারের আলাদা ঐতিহ্যতো আছেই। তবে বাহারি নামের কারণেই সুদানিদের প্রসঙ্গটা এলো।
ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া এক লেখা বেশ মনোযোগ কাড়লো। ‘মুড়ির জীবনটা আসলে মানুষের মতোই। শুরুতে মানুষের মতো হ্যাংলা পাতলা নিষ্পাপ চাউল থাকে। তারপর বালুর মধ্যে ফেলে মানুষের জীবনের মতো ভাজা ভাজা করা হয়! ধীরে সুস্থে ফুলেফেঁপে ওঠে। বড়সড় হয়। বেগুনি পেঁয়াজুর মতো অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারপর একসময় পুতায়া যায়’।
মানুষের জীবনটা কেমন? এর উত্তরে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন অনেকে। তবে রমজান মাসে উল্লেখ করবো বর্ণিল চরিত্রের অধিকারী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের একটি ঘটনা।
নজরুল তখন শ্যামাসংগীত লিখে হিন্দুদের কাছে বিখ্যাত। কালীপূজাতে বাজানো হচ্ছে নজরুলের শ্যামাসংগীত। অন্যদিকে মুসলমানরা মহাখ্যাপা। নাস্তিক, মুরতাদ কতো উপাধি জুটছে নজরুলের কপালে। একদিন নজরুলের ঘনিষ্ঠ শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন নজরুলকে বললেন, ওস্তাদ আপনি হিন্দুদের জন্য এতো দারুণ দারুণ গান লিখছেন মুসলিমদের জন্যও কিছু লিখেন। কথাটি শুনে নজরুল ভাবনায় পড়ে গেলেন। সে রাতেই লিখতে বসলেন, এবং লিখলেন, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ’। সারারাত জেগে এ গান লিখেন এবং রাতেই তাতে সুর করেন। আব্বাস উদ্দিন এ গানে প্রথম কণ্ঠ দেন। ১৯৩১ সালে লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামাফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে।
এর পরেরটাতো ইতিহাস। বাঙালি মুসলমানদের কাছে পবিত্র ঈদুল ফিতরের উৎসবে কালজয়ী এ গান অন্যতম অনুষঙ্গ। আর বাঙালি হিন্দুদের কালীপূজায়, নজরুলের ‘বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলি রে তুই শ্যামা মায়ের চরণতল’ এমন সংগীত ছাড়া চলেই না।
করোনার মধ্যে রমজান, ঈদ সমাগত। আর্থিক অনটন, কিছু মানুষ এখনো ফিরছেন অন্নের সংস্থানে। যতটুকু জানি, দরিদ্রকে দান করার বিষয়েও ইসলামের সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। প্রতিটি ধর্মই মানবতার কথা বলে। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একটা বাণী এ প্রসঙ্গে মনে পড়লো, ‘পড়শিরা তোর নিপাত যাবে, তুই বেঁচে সুখে খাবি বুঝি/যা ছুটে যা তাদের বাঁচা। তারাই যে তোর বাঁচার পুঁজি’। আসলে অন্যের উপকার করলে, অন্যকে সুখী করলে নিজেরও সুখ হয়।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ যখন অন্যকে হঠাৎ সাহায্য করে, খুশি করে, তখন তার মস্তিষ্কে তৈরি হয় ডোপামিন আর সেরোটোনিন। এই দুটি রাসায়নিক পদার্থকে বলে ‘হ্যাপি কেমিক্যাল’। আমাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর অনুভূতি এই দুটি যৌগ নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আপনি যখন অন্য কাউকে অপ্রত্যাশিতভাবে সামান্য উপকার করেন, আপনার মস্তিষ্ক সঙ্গে সঙ্গে আপনার ভেতরে একধরনের আনন্দ, ভালোলাগা বা তৃপ্তির বার্তা দেয়। এতে আপনি আরও উদ্যমী, সজীব হয়ে ওঠেন। শুধু তা-ই নয়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীর মস্তিষ্কেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ কর্মজীবনেও সফল। কাজের জায়গায় জনপ্রিয়। গবেষকেরা বলছেন, অন্যের উপকার কয়েকবার করার পর আমাদের মস্তিষ্ক সেটাকে অভ্যাসে পরিণত করে। কারণটা খুব পরিষ্কার। ডোপামিন নিঃসরণের কারণেই আমাদের আনন্দানুভূতি হয়। নানা কারণেই ডোপামিন নিঃসরিত হয়। মস্তিষ্ক এই কারণগুলোকে মনে রাখে। তারপর বারবার আমাদের এই কাজগুলো করতে উৎসাহিত করে। শেষ করবো ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের লেখা একটি ছড়ার কয়েকটি লাইন দিয়ে-
‘চুরির টাকায় কাঁচাবাজার, লুটের টাকায় জামা-
ঘুষের টাকায় টুপি কিনে রোজা করছেন মামা!
রোজার মাসে খাওয়া দাওয়ায় মামা ভীষণ চালু!
সেহরি খেলেন মুরগীর ঝোলে সঙ্গে নতুন আলু।
পিঁয়াজু আর ছোলা মুড়ি খান মামা ইফতারে
মরার পর বেহেশত মামার কে ঠেকাতে পারে?’
শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক