শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

ভালোবাসা দিবসের গল্প : ‘লাইভ’ থেকে যখন ‘লাইফে’

| প্রকাশিতঃ ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১ | ১২:১২ অপরাহ্ন

সৈয়দা সাজিয়া আফরিন : ২০১৩ সালের ৭ ফ্রেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে গণজাগরণ মঞ্চের দামামা কাভার করতে এসেছিলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের তৎকালীন রিপোর্টার আশরাফুল আলম। লাইভ সম্প্রচারে অনেকের মতো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাইতে আসা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী সাদিয়া উলফাতকে যুক্ত করেন তিনি।

এটি ছিল স্রেফ পেশার তাগিদ। কে জানত এই তাগিদ থেকে প্রেম অতপর জীবনের তাগিদ তৈরি হবে। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। ক্ষণিকের চোখোচুখি থেকে তারা আজ অনুক্ষণ মুখোমুখি, প্রেমজীবনের অনন্য সাধারণ উপমা।

প্রথম দেখাতেই অজান্তে বাঁধা পড়ে দুটি মন। ক্ষণিকের পরিচয় গড়ায় তুমুল প্রেমে। তারপর-প্রেমকাহন থেকে জীবনকাহন। চুটিয়ে প্রেম করে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে ঘুরে বেড়ানোর পর পারিবারিক সম্মতিতে ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর পরিণয়ে বাঁধা পড়ে দুই জীবন।

লাইভ থেকে লাইফে এসে পড়ে দুটি মানুষের জীবনের মোড়। এভাবেই এক হলো জামালখানের মেয়ে সাদিয়া ও ফেনির ছেলে আশরাফুল আলমের দ্বৈত জীবন।

এরপর ২০১৭ সালে উচ্চশিক্ষার্থে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চলে যান তারা। সেখানে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পড়ছেন দুজন। পার্টটাইম জবও করেন সেখানে।  জ্ঞানের ক্ষুধা, পেটের ক্ষুধা নিবারণের পর বাকি সময়টা প্রেমের ক্ষুধা নিবারণেই কাটান তারা। দুর্দান্ত এই প্রেমিক দম্পতির প্রেমের উপাখ্যান সিডনিতেও বেশ আলোচিত।

ভালোবাসা দিবসের আগের দিন শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) জামালখান থেকে সুদূর সিডনির পারামাটা নদীর কিনারে থাকা সাদিয়া উলফাতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম প্রেমের শুরুর গল্পটা।

শুনুন তবে সেই গল্প সাদিয়ার মুখেই; ‘২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আমি বাসায় ফেরার সময় দেখলাম যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি বরাবরই আবেগী। কারণ আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি রিকশা থামিয়ে সেখানেই নেমে পড়ি। ভিড়ের মধ্যে আমি শাদা শার্ট পরা একটি ছেলেকে দেখি। তাকে দেখা যাচ্ছিল পেছন থেকে। কেন জানি তাকে দেখতে মন চাইল। তাকে দেখতে আমি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাই। তখন বুঝলাম- হুম, হি ইজ জার্নালিস্ট। লাইভে তিনি কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া জানছিলেন, জানলেন আমারও। ব্যস এটুকুই। আর কোনো কথা হয়নি সেদিন।

সাদিয়া উলফাত বলেন, পরের দিন আবারও যাই। মনে মনে বলছিলাম ছেলেটি হয়তো থাকতে পারে ওখানে। তাই হলো। সে আছে। সেদিন আমার হাতে মাইক্রাফোন ধরিয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘ মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি জন্ম নেননি। তবুও গণজাগরণ মঞ্চে এসেছেন। কীভাবে এল এ আবেগ।’ আমি উত্তর করেছিলাম। মাইক্রোফোন হোল্ড করার সময় তার হাতে আমার হাতের স্পর্শ লাগে। আমি স্যরি বলেছিলাম।

কিন্তু সেদিন বাসায় ফিরে টিভিতে আমি নিজেকে দেখিনি। বরং দেখলাম সে অন্য একটি লাইভ করছে। খুব অভিমান হয়েছিল। পরেরদিন আবারও গেলাম। ভিড় ঠেলে সোজা তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘এই যে আপনার ফোনটা দিন তো?’ তার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নিজের নম্বরে ডায়াল নম্বরটি সেভ করে বাসায় ফিরে টেক্সট করেছিলাম।

সাদিয়া বলেন, এরপর থেকে আমাদের কথা হতে থাকে। এক সপ্তাহ পর ছিল ভ্যালেনন্টাইন্স ডে। সেদিন দেখা হল বাতিঘরে। ছোট ছোট আড্ডা হলো, কফি খাওয়া হল। তবে আমি যা আশা করেছিলাম তা হয়নি। আশা করেছিলাম সে প্রপোজ করবে। সেদিন ফরম্যালি ‘লাভ ইউ’ বলেনি সে। সে অফিসে চলে গেল। উই কেপ্ট ইন টক অ্যাজ ফ্রেন্ড। তবে আমি মনের গভীরে জানতাম ‘সে আমার’।

আরও এক সপ্তাহ গড়ালে সে একদিন বলেই ফেলে- ‘তুমি কি বুঝতে পারছো না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি?’ তৎক্ষণাৎ আমি কী যেন ভেবে প্রত্যাখ্যান করি, বলি আমরা শুধু বন্ধু থাকব। অন্যদিকে তাকে আমি ভালোবাসি এমনও মনে হত। একদিন স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকার একটি কাবাবের দোকানে বসি আমরা। আমি জানি না কেন যেন সেদিন আমি তার হাত ধরলাম। সেদিনই নিশ্চিত হয়েছিলাম হ্যাঁ- ‘ওই আমার মনের মানুষ’।

‘এভাবে একবছর কাটলো। পরের বছর ৬ ফেব্রুয়ারি সে ঢাকা চলে গেল। ২০১৫ সালে সে এসে আমাকে প্রপোজ করল। ফ্যামিলিতে গেল। মজার ব্যাপার কী জানেন- আমরা দুজনে মিলেই আমার বাসায় আনা মিষ্টিগুলো কিনি। মিষ্টি কিনে আমি বাসায় ফিরে যাই, আর ওকে বলি তুমি দুই ঘণ্টা পর এসো। প্রথমে ও এলো তারপর ওর ফ্যামিলি আসলো। ২০১৫ এর ১১ অক্টোবর আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পরেও আমরা দূরে দূরেই ছিলাম। ও ঢাকায় আমি চট্টগ্রামে। দুজনে কোনো সংসার শুরু করিনি। প্রেমটাই কেবল স্বীকৃত হয়েছিল।’

এরপর ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আমি উচ্চশিক্ষার্থে অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। এসেই রিয়েলাইজ করি ‘আমি একা’। এর আগে কখনও এমন মনে হয়নি। সবকিছু শূন্য লাগতো তাকে ছাড়া। আমি খুব ডেসপারেট হয়ে যাই তাকে নিয়ে আসতে। ওর ভিসা হয় এবং সে সিডনি আসে ২৩ সেপ্টেম্বর। বিয়ের পর আমরা একসাথে থাকিনি। সিডনিতেই শুরু হয়েছিল আমাদের সংসার।শুরুর কিছুদিন খুব স্ট্রাগল ছিল।

আশরাফুল আলন বলেন, ‘তার সাথে আমার প্রথম দেখা ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছি। সেদিন লাইভ কাস্ট করতে গিয়েছিলাম। সাদিয়া আমার কাছাকাছিই ছিল। আমার প্রয়োজন প্রশ্ন করার জন্য একটা ‘সাবজেক্ট’। আমি সাদিয়ার হাতে মাইক্রোফোন দিলাম। সেদিনের পরিচয়টুকু আমার মনে থাকত না, যদি সহকর্মীরা মজা করে প্রসঙ্গটা না তুলতেন। সেদিন ফুটেজটা দেখে ভাবছিলাম, বাহ, সে তো প্রেমে পড়ার মতই মেয়ে।পরেরদিন তাকে আবারও দেখব এজন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ৯ তারিখ ছাদ থেকে ক্যামেরা ঘুরাতেই দেখি সাদিয়া গণজাগরণ মঞ্চের ভিড়ে বসে আছে। তার কাছে নোটিশেবল হওয়ার জন্যেই আমি নিচে নামি। সামনের দোকানে দাঁড়িয়ে চা কিনি। সে এগিয়ে আসতেই আমি নিজে থেকেই বলি আমার নম্বর নিতে চান? আমি ভীষণ সোজাসাপটা সে খুব আবেগী এমন। আমার যা মনে আসত বলেই দিতাম।’

১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেখা হয়। যদিও সেদিন আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ভালোবাসি বলিনি। সে খুব আহত হয়েছিল মনে মনে। সে আশা করেছিল সেদিন আমি ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে রেডি হয়ে এসে তাকে হাঁটু গেড়ে ভালোবাসি বলব। আর সেদিন আমি সাধারণ পোশাকেই দেখা করি তার সাথে। আমি বরাবরই এমন। যখন সে আশা করছিল প্রেমের প্রস্তাব দেব তখন আমি বিয়ের কথাই বলে ফেলি।’ – যোগ করেন আশরাফ।

আশরাফুল বলেন, ‘আমাকে সে কয়েকবার প্রত্যাখ্যান করে। প্রথমে সে নিজে অ্যপ্রোচ করলেও পরে সে কনফিউজ হয়ে যায়। এভাবেই আমাদের প্রেম পরিণতি পেল। সাত বছরের যুগলবন্দিতে ছয়টি ভালোবাসা দিবস পেরিয়ে এসেছি।’

উল্লেখ্য, আশরাফুল আলমের বাড়ি ফেনির সোনাগাজীতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করেছেন তিনি। সাদিয়া উলফাতের দাদার বাড়ি বোয়ালখালী। তবে তার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ তৌহিদ ও কামরুজ্জাহানের বড় মেয়ে।