নুরুল আবছার : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের ফরেস্ট অফিসের পাশে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিতে চিরঘুমে আছেন ১৩ জন শহীদ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই ১৩ জনকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যার পর মাটিচাপা দেয়ার বর্ণনা শুনে এখনো গা শিউরে ওঠে অনেকের।
কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকাখচিত সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসে তাদের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যাননি কেউ।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে এসেও পাক-বাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী এই ১৩ জন শহীদের গণকবরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে এই জাতির কার্পণ্য- নানা প্রশ্ন তুলেছে নতুন করে।
সারাবছরই তো অনাদর-অবহেলায় শহীদরা ঘুমিয়ে থাকেন। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসে অন্তত প্রতীকী শ্রদ্ধা জানাতেও যে কেউ যাননি; তা এ সময়ে ভাবাটা কতটা লজ্জার তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।
এদিকে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর পর এই স্থানে মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি চিহ্নিত করে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে চার লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে জেলা পরিষদ। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ বধ্যভূমিতে যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। ফলে রাস্তা না থাকায় যাতায়াত করাটা কষ্টকর ভেবেও অনেকে যাচ্ছেন না সেখানে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই বসে মাদকাসক্তদের আড্ডা, মাদকাসক্ত-জুয়াড়িদের মিলনমেলায় পরিণত হয় এ বধ্যভূমি। দিনের বেলায় গরু-ছাগল চরে বেড়ায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে থাকা বধ্যভূমি মাদকাসক্ত আর জুয়াড়িদের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ায় তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোমরা বধ্যভূমি এলাকার একাধিক ব্যক্তি একুশে পত্রিকাকে জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে বখাটেরা মাদকসেবন করতে আসে। ভয়ে কেউ তাদের বাধা দেন না। বিজয় দিবসের সময় এলে কয়েকদিন বখাটেরা যান না, পরে আবার নিয়মিত আড্ডা বসে।
জানতে চাইলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, এই বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। তারপরও আমি ওসিকে বলে দেবো এই বিষয়ে।
এ বিষয়ে পোমরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়াম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা কুতুব উদ্দীন একুশে পত্রিকাকে বলেন, এখানে যে মাদকাসক্তদের আড্ডা হয় তা আমি জানি না। যদি এরকম কিছু হয় তাহলে ব্যবস্থা নেব। আর বিজয় দিবসে আগেও সেখানে ফুল দিতে যেতাম না, তাই এখনও যাইনি।
চট্টগ্রাম বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ড. গাজী সালাহ উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, যে-কোনোভাবে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে ফেলে রাখাটা উচিত নয়। নির্মাণের পর আরও দায়-দায়িত্ব থাকে। যারা রক্ত দেয়নি তারা আসলে এটার গুরত্ব বুঝবে না। এজন্য সরকারের উচিত বধ্যভূমিতে কবরস্থ হওয়া শহীদদের স্বজন ও উপজেলা প্রশাসনকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য কমিটি করা।
প্রসঙ্গত, পোমরা বধ্যভূমিতে গণকবর দেওয়া ১৩ জন বীর শহীদ হলেন- মন্টু আইচ, গান্ধী দাশ, রমনি দাশ, হরিপদ দাশ, জগৎ চন্দ্র দাশ, বাবুল চন্দ্র দাশ, বিরাজ দে, বোচা দে, ফকির চাঁদ, খোকা দাশ, দুলাল দাশ, শচীন দাশ ও হরিকৃষ্ণ দাশ।
দেশের জন্য লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনার জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদেরই একজন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পশ্চিম কলাউজান ৬ নং ওয়ার্ডের মৃত রামানন্দ দেব নাথের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রজেন্দ্র লাল দেব নাথ।
যুদ্ধকালীন সময়ে তার নাম ছিল ক্যাপ্টেন করিম। এ ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পোমরা ইউনিয়নের মধুরাম পাড়া সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করে দেয়। পরদিন ১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এসে মধুরাম পাড়ার মানুষদের দায়ী করে।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে তারা পোমরা মধুরাম পাড়ার ১৩ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে তাঁদের সবাইকে পোমরা ফরেস্ট অফিসের পিছনে পাহাড়ের পাদদেশে আনা হয়। সেখানে ওই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা গর্ত খুঁড়ার পর ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এরপর তাঁদের প্রত্যেককে গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে গণকবর দিয়ে চলে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।