মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন : ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর- এদিন রাতে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান আনোয়ারার প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ আহসানুল হুদা। তাঁর চলে যাবার সাথে সাথেই শেষ হয় আমাদের মফস্বল সাংবাদিকতার এক সোনালী অধ্যায়ের। সৈয়দ আহসানুল হুদাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম, গর্ব করতো আনোয়ারার সাধারণ মানুষেরাও। তিনি সারাজীবন আনোয়ারাবাসীর পাহারাদার হয়ে ছিলেন।
২০০৮ সালে যখন সৈয়দ আহসানুল হুদা মারা যান, তখন পর্যন্ত হিসাব করলে আমার বয়সের চেয়ে তাঁর সাংবাদিকতার বয়স ছিল বেশি। ১৯৭৭ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন সৈয়দ আহসানুল হুদা। পরে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে কাজ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের প্রাচীনতম পত্রিকা দৈনিক আজাদীর আনোয়ারা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে গেছেন। অনোয়ারাসহ প্রায় সব জায়গায় তিনি ‘আহসান সাহেব’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
সূদুর ভারতে চিকিৎসাধীন থাকার সময় সৈয়দ আহসানুল হুদার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো, আর তা আজাদীতে সংবাদ প্রেরণ নিয়ে। আজাদীতে সংবাদ ছাপানোর জন্য যোগাযোগ রক্ষা করতেন আজাদীর তৎকালীন সহসম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক ও শাহ আজম সাহেবদের সাথে। অন্যদিকে ভারত থেকে আসার পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের সহায়তায় ছুটতে দেখা গেছে সৈয়দ আহসানুল হুদাকে। অসহায়দের সাহায্য করতেন কোন ধরনের উদ্দেশ্য ছাড়াই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি থাকতে পেরেছেন সৎ, নির্লোভ।
২০০০ সাল থেকে যখন আমি দৈনিক পূর্বকোণে কাজ করি, তখন থেকে আহসানুল হুদার সঙ্গে আমার ভালোভাবে পরিচয়। তাঁর সাথে পরবর্তীতে আমার এতো বেশী সখ্যতা গড়ে ওঠে, যা বলে প্রকাশ করার মতো না। আমি তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতাম বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময়ে। আর জেনে নিতাম কীভাবে তিনি আনোয়ারার সেরা মানুষদের মধ্যে একজনে পরিণত হলেন। সৈয়দ আহসানুল হুদা বলতেন, সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য কাজ করতে আর কাজের মূল্যায়ন করবে তারাই। এর প্রমাণও পাওয়া যায়, তাঁর অসুস্থতার সময়ে। অসুস্থ অবস্থায় আমরা দেখেছি, তাঁকে দেখতে, দোয়া করতে অনেক রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুকও তার ঘরে গিয়েছেন। তাঁকে স্পর্শ করিয়ে, মুরগী সদকা করতে দেখা গিয়েছিল অনেককে। তাছাড়া, আনোয়ারার অনেক মসজিদ-মাদ্রাসায় তার রোগমুক্তির জন্য খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিল করা হয়েছিল।
সৈয়দ আহসানুল হুদাকে দেখেছি, পত্রিকায় কখনো কোনো সংবাদ কিংবা ফিচারে ক্যান্সার শব্দটি দেখলে কলম দিয়ে কেটে দিতেন। শব্দটি কেন কাটছেন জানতে চাইলে তিনি বলতেন, আমার মা-ভাগ্নেসহ অনেকে প্রাণ হারান এ রোগে, তাই এ শব্দটা আমি কোথাও পেলে কেটে দিই। কাকতালীয়ভাবে সে ক্যান্সারেই মারা গেলেন তিনি।
শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার অনেক আগে থেকেই সৈয়দ আহসানুল হুদা কোনো ডাক্তারের কাছে গেলে পরীক্ষা দিলে করাতে চাইতেন না। যদি কোন খারাপ রিপোর্ট আসে এই ভেবে। ২০০৮ সালের মে মাসের দিকে তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লে আনোয়ারার মানুষজন বিচলিত হয়ে পড়েন। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামসহ চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেয়ার সময় ডাক্তাররা জানান, কেমোথেরাপির মাধ্যমে এ রোগ থেকে সেরে ওঠা যাবে। তবে টাকা লাগবে ১০ লাখেরও বেশী। কিন্তু এত টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? সারা জীবনে তো তিনি কিছুই করতে পারেননি। থাকেন কুঁড়েঘরে।
চিকিৎসার উদ্যোগ নেন চট্টগ্রাম শহরের কয়েকজন সাংবাদিক, তাঁর বন্ধু, আনোয়ারায় সহকর্মী সাংবাদিক, শিক্ষক ও সর্বস্তরের মানুষ। যে করেই হোক বাঁচাতে হবে আহসানকে। রাতারাতি আসতে লাগলো টাকা। উন্নত চিকিৎসা ও থেরাপি দেয়ার জন্য ভারতের ভেলোরে সিএমসি হাসপাতালে পাঠানো হল তাঁকে। যখন তিনি প্রথমবার ভারত যাচ্ছিলেন তখন তার কণ্ঠস্বর ছোট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম থেরাপিতেই তিনি পেলেন দারুণ সফলতা। ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছিল মুখের আওয়াজ। প্রথম কেমো দেয়ার পর ভারত থেকে হাসিমুখে আসার পর আবার নতুন উৎসাহ নিয়ে পুরোদমে শুরু করলেন সাংবাদিকতা। আর সংবাদ কিংবা লোকালয়ের ফিচার পাঠানোর জন্য আমাকে তাঁর পাশে থাকতে হতো সবসময়। কেননা, আজাদীর বেতন ছাড়া তার আর কোনো আয়ের পথ ছিল না। কারো কাছ থেকে কোন সুবিধা না নেয়ার কারণে তাকে ভরসা করতে হতো আজাদীর বেতনের উপর। তাঁকে কারো কাছ থেকে কখনো কিছু নিতেও দেখেননি আনোয়ারাবাসী।
সর্বশেষ কেমো দেবার পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সৈয়দ আহসানুল হুদাকে নিয়ে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ডা. শরিফুল আলমের কাছে যাই। সে সময় তিনি আমাকে জানান চিকিৎসা শেষে আগামী দিনগুলোতে আনোয়ারার অবহেলিত মানুষগুলোর জন্য কী কী কাজ হাতে নেবেন। ডা. শরিফুল আলমের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে শেষবারের মতো ভারত গিয়ে তিনি ডাক্তারের সাথে দেখা করে চলে আসবেন। কেননা, তিনি ভালো হয়ে গেছেন পুরোপুরি, ভারতের ডাক্তারের পরামর্শের জন্যই মাত্র ভারত যাওয়া। কিন্তু বিধিবাম। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, শরীরের রোগ আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আর পুণরায় চিকিৎসা করাতে লাগবে ন্যূনতম ১৮ লাখ টাকা। হতাশ হয়ে দেশে এসে শেষতক; ঢাকার একটি হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেবার সময় ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি ২ মেয়ে ও স্ত্রীকে রেখে যান। তিনি যখন মারা যান তখন তার বড় মেয়ে ২য় শ্রেণীতে উঠার পথে।
এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন তা ভাবেননি সৈয়দ আহসানুল হুদা। বেঁচে থাকার বেশী ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু তা হলো না। সুস্থ হওয়ার পথে থেকেও নিয়তির কারণে চলে গেলেন ইহকাল থেকে, চিরদিনের জন্য। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর পরিবার শুধু তাকেই হারায়নি, আমরা হারালাম একজন সৎ ও আদর্শবান সাংবাদিককে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। সৈয়দ আহসানুল হুদা ছিলেন আদতে মফস্বল সাংবাদিকতা ও সততার প্রতিকৃতি। নীতি, ধর্ম পরায়ণতা ও আদর্শের কারণে পরকালে আল্লাহ তাঁকে শান্তিতে রাখবেন, এটা আমি বিশ্বাস করি। ১২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গুণী এ সাংবাদিককে স্মরণ করছি অপার শ্রদ্ধায়।
লেখক: প্রথম আলোর আনোয়ারা উপজেলা প্রতিনিধি