জিন্নাত আয়ুব, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) : গ্রামে স্কুলপড়ুয়া সমবয়সী ছেলেদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানো নিয়ে অন্যদের অভিভাবকরা যখন ব্যস্ত, তখন তাঁর কলেজশিক্ষক বাবা শেখ ফিরোজ আহমেদের সাফ কথা, লেখাপড়া করে ‘ভালো মানুষ’ হতে হবে। স্কুলশিক্ষক মা জোবায়দা আখতারেরও একই কথা। এজন্য তাদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণার কমতি ছিল না। এই ভালো মানুষ হতে গিয়ে শেখ জুবায়ের আহমদ এখন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
সম্প্রতি নিজের কার্যালয়ে বসে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ার গল্প শোনালেন শেখ জুবায়ের আহমদ। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হবো- এরকম পরিকল্পনা দূরের কথা, কখনো সরকারি চাকরি করবো এরকমও ভাবিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস দিয়েছি, তখন এই চাকরিতে এসে পড়েছি। তবে এখানে এসে ভালোই হয়েছে। এখন যেভাবে জনসেবা করার সুযোগ পাচ্ছি, অন্য পেশার সেটা সম্ভব নয়।’
‘ছোটবেলায় বাবা বলতেন, পড়ালেখা করে আমাকে ভালো মানুষ হতে হবে। লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে আমার মায়ের অনুপ্রেরণা ছিল বেশি। তাঁদের কথামতো আমিও বড় হয়ে ভালো মানুষ হতে চেয়েছি। এজন্য বই পড়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। কারও মধ্যে খারাপ আচরণ দেখলে তাকে এড়িয়ে চলতাম। ছোটবেলায় এভাবে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা থেকেই হয়তো আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছি। এখনো বাবার কথামতো প্রতিনিয়ত ভালো মানুষ, মানবিক মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি।’ যোগ করেন ইউএনও শেখ জুবায়ের আহমদ।
টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্ম নেয়া শেখ জুবায়ের আহমদ শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, এখনো শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনার দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়ে ফিরি। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনার দিনগুলো। বিশেষ করে গ্রামের পথে হাঁটা, দলবেঁধে সাইকেলের টায়ার চালানো, খালের পানিতে মাছ শিকারের নামে সারাদিন পানিতে হই-হুল্লোড় করাসহ আরো কতো স্মৃতিই মনের দুয়ারে উঁকি দেয় এখন। সে দিনগুলো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এখনো শৈশবের উপর ভর করে চলি।
শেখ জুবায়ের আহমদ প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নেন দেউলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর সখীপুরের সূর্যতরুণ শিক্ষাঙ্গন থেকে মাধ্যমিক ও ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন উচ্চশিক্ষার পাঠ। শেখ জুবায়ের আহমদ বলেন, আমি খুবই ভাগ্যবান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বর্ণালি সময় অতিবাহিত করেছি। আরও সৌভাগ্য পরিসংখ্যানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পড়তে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ দেন শেখ জুবায়ের আহমদ। কর্মজীবনের শুরুতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে চট্টগ্রাম নগরের কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসে কর্মরত ছিলেন।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আনোয়ারার ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ জুবায়ের আহমদ। এরপর উপজেলা প্রশাসনকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজান। উদ্যোগ নেন দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করে আনোয়ারাকে একটি আধুনিক উন্নত জনপদ হিসেবে গড়ে তোলার।
প্রথমেই তিনি সিসিটিভি ক্যামেরার স্থাপন করে পুরো উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম মনিটরিং শুরু করেন। এতে উপজেলা পরিষদ চত্বরে কমে যায় দালাল-অপরাধীদের আনাগোনা। শক্তহাতে ভূমিদস্যু, বালুখেকো, খাস জমি, খাল ও নদী দখলদারদের লাগাম টেনে ধরেন।
বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসনকে জনবান্ধব ও বিপদগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলেছেন তিনি। এই উপজেলায় তাঁর দায়িত্বকাল দেড় বছর পূর্ণ হয়েছে। এ সময়ে শেখ জুবায়ের আহমদের কর্মদক্ষতায় পাল্টে গেছে উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম ও সার্বিক চিত্র। সরকারি প্রতিটি দপ্তরের কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা এসেছে। কমেছে জনভোগান্তি, বৃদ্ধি পেয়েছে জনসেবার মান।
নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ও করোনাকালে জনকল্যাণমুলক কাজ করে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে উপজেলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন শেখ জুবায়ের আহমদ। প্রভাবশালী মহলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নজির স্থাপন করছেন জনবান্ধব এ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
তাছাড়া গণমাধ্যম, ফেসবুক, মুঠোফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগের দ্রুত সমাধান ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।
আনোয়ারার ইউএনও শেখ জুবায়ের আহমদ বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের সেবক। নিজে কী পেলাম সেটা বড় কথা নয়, দেশ ও জাতির জন্য কী করতে পারলাম সেটাই বড় কথা। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সব সময় চেষ্টা করি মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের। আমি হয়তো একদিন এই উপজেলায় থাকবো না, কিন্তু থেকে যাবে আমার কর্ম। যদি ভালো কাজ করে যেতে পারি, তাহলে আনোয়ারাবাসী আমাকে আজীবন মনে রাখবে।’