জসিম উদ্দীন, কক্সবাজার : রোহিঙ্গা জনপদের অঘোষিত রাজা ছিলেন তিনি। ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা থেকে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। অপকর্ম ঢাকতে তিনি কিনে নিতেন সংশ্লিষ্টদের। রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩ দশক ধরে একচ্ছত্র রাজত্ব করে পরিচিতি পেয়েছিলেন, ‘দ্বিতীয় বদি’।
এমন একজন মানুষের যে হঠাৎ পতন হবে কারও ভাবনায়ও ছিল না। গত ২৩ জুলাই রাতে টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বখতিয়ার আহমেদ ওরফে বখতিয়ার মেম্বার (৫৫)। তিনি উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং এলাকার বাসিন্দা ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন।
টেকনাফে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা আবদুর রহমান বদির খুব আস্থাভাজন ছিলেন বখতিয়ার। বদির টাকার মেশিন ও ভোট ব্যাংক হিসেবেও বখতিয়ার পরিচিত ছিলেন। তার ছেলে হেলাল উদ্দীন আবদুর রহমান বদির প্রেস সচিব।
মৃত্যুর পর বখতিয়ারের অপকর্মগুলো সামনে আসছে। এতদিন তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। যারাই তার বিরুদ্ধে গিয়েছে তাদের জীবন তছনছ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বখতিয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ্র গ্রহণ করতো না বলে অভিযোগ আছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওগুলোকে বখতিয়ারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে কাজ করতে হতো বলে জানিয়েছেন কয়েকজন এনজিওকর্মী।
স্থানীয়দের দাবি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী এনজিওগুলো বখতিয়ারকে ব্যবহার করে প্রত্যাবাসন ঠেকিয়েছে। যখনই প্রত্যাবাসনের জোরালো আলোচনা চলতো তখনই বখতিয়ারের ইশারায় শত শত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচার চালাতো। পাশাপাশি মিয়ানমার নিরাপদ নয়- জানিয়ে কেউ সেখানে যেতে রাজি হলে তাকে হুমকি দিত।
সর্বশেষ যেসব রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে যেতে রাজি হয়েছিল তারা ওই সময় বখতিয়ারের সন্ত্রাসী বাহিনীর হুমকিতে পিছু হটেছিল।
বখতিয়ার পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সহজ সমাধান দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবিরের সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক ছিল বখতিয়ার। রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, গুম, খুন, অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতো বখতিয়ার। এসব দেখভাল করতেন বখতিয়ারের ছেলে ও বদির প্রেস সচিব হেলাল উদ্দীন।
অভিযোগ উঠেছে, কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরকারি জমি দখল করে ৫ শতাধিক দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন বখতিয়ার। এক হাজারের অধিক দোকান থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করে আসছে তার লোকজন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লম্বাশিয়া নামক এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে মালবাহী গাড়ি থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা তুলে বখতিয়ারের বাহিনী।
এ ছাড়াও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইলসহ প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য কেনা-বেচা হলে মোট দামের একটা অংশ বখতিয়ার বাহিনীকে দিতে হয় বলে জানিয়েছে সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা আহমদ গিয়াস বলেন, ৯১ সালের দিকে টং দোকানে চা বিক্রি করতেন বখতিয়ার। সে সময় দেশে রোহিঙ্গা আসা শুরু করে। তখন রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা আরম্ভ করেন বখতিয়ার। রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে এখন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। সবই করেছেন লুটপাট ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে।
স্থানীয় বাসিন্দা সালাউদ্দীন একুশে পত্রিকাকে বলেন, বখতিয়ারের ছেলে হেলাল উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা উচিত। এছাড়া সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ ও অর্থ যোগান বন্ধে তাদের ৪ শতাধিক অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। তাহলে রোহিঙ্গা জনপথ থেকে সন্ত্রাস বিদায় নেবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক ইয়াবা কারবার বন্ধ হবে। পাশাপাশি সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশ পেলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাজি করানো অনেকটা সহজ হবে।
উখিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, বখতিয়ার মেম্বারের হুকুমের বাইরে যাবার ক্ষমতা রোহিঙ্গা বা স্থানীয় কারো ছিল না। তিনি বলেন, বখতিয়ার মেম্বার রোহিঙ্গা রাজা হিসেবে পরিচিত। তার সবই সবার জানা ছিল। কিন্তু তার কাছ থেকে মোটা অংকের সুবিধা নিয়ে তার পক্ষে কথা বলেছে সবাই।
কক্সবাজার জেলা কমিনিউটি পুলিশিং এর সভাপতি ও সাংবাদিক তোফাইল আহমদ বলেন, রোহিঙ্গা রাজা বখতিয়ারের টাকা ও ক্ষমতার দাপটে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইউএনএইচসিআর পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছিল।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করেছিল বখতিয়ার মেম্বার। পরে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হলে কারাবাস করতে হয়। মামলাটি পরিচালনা করেছিল ইউএনএইচসিআর। কিন্তু একজন সাবেক সাংসদের সহযোগীতায় রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা থেকে মুক্তি পান তিনি।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবার চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবির কেন্দ্রিক দেশের জন্য হুমকি নানা কার্যকলাপ। এর সঙ্গে বখতিয়ার জড়িত ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর যা জিজ্ঞাসাবাদে বখতিয়ার নিজেই স্বীকার করেছেন অকপটে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, বখতিয়ার আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর কাছে বলেছেন, তিনি কাউকে ভয় পান না। টাকা দিয়ে সবাইকে কিনতেন। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা, সাংবাদিকসহ অনেককে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক মাসোয়ারা দিত সে। কাকে কত টাকা দিত সেসব তথ্য আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর কাছে দিয়ে গেছে বখতিয়ার।
র্যাব-১৫ কক্সবাজারের উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও মাদকের সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক, যতই ক্ষমতাশালী হোক, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সেভাবে এগুচ্ছে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা রাজা বখতিয়ার ও সাইফুল করিম যখন রেহাই পায়নি, বাকিরাও পার পাবে না।