সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

দিয়াজ মৃত্যু-রহস্য : ঢামেকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন

প্রকাশিতঃ ২৯ অগাস্ট ২০১৭ | ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রাম: ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কোমাতে চলে যাওয়ার পর দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর শ্বাসরোধে মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কোমাতে যাওয়ার জন্য ব্রেইনে যে আঘাতের উপস্থিতি থাকা দরকার তা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। এবার তাই এ প্রতিবেদন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের দুটি অংশ থাকে। একটি মৃত্যুর কারণ এবং অপরটি মৃত্যুর ধরন। আঘাত ও রক্তক্ষরণ হচ্ছে মৃত্যুর কারণ। আর হত্যা, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনা হচ্ছে মৃত্যুর ধরন। খুন, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা বা অন্য কোনোভাবে কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে মৃত্যুর কারণ ও ধরন জানতে মৃতদেহকে ব্যবচ্ছেদ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন ফরেনসিক চিকিৎসকেরা, যা ময়নাতদন্ত নামে পরিচিত।

এদিকে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় দুই মেডিকেল কলেজের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দুই রকমের হওয়ার বিষয়টি নিয়ে চারজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে সবার মতামত প্রায় একই আসে। তবে পেশাগত ঝুঁকির কারণে তারা কেউই পরিচয় প্রকাশে রাজী নন।

প্রথমে দিয়াজের দুটি ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় ২৫ বছর ধরে ময়নাতদন্ত করে আসা একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের কাছে। ঢামেক ও চমেকের ফরেনসিক বিভাগের দেওয়া প্রতিবেদনের সবকিছু বিশ্লেষণ করে তিনি মতামত দেন, ‘ঢামেকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছে দিয়াজ। চমেকও একই কথা বলেছে। চিকিৎসকদের ভাষায় শ্বাসরোধে মারা যাওয়া মানেই আত্মহত্যা নয়। এই শ্বাসরোধ নিজে নিজেও হতে পারে, অন্য কেউ শ্বাসরোধ করেও হত্যা করতে পারে। তবে শ্বাসরোধে মৃত্যু হয়েছে আলামত পেলেই ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা মতামত দেন, আত্মহত্যা হতে পারে। অবশ্য পরবর্তীতে পুলিশের তদন্তে হত্যার প্রমাণ উঠে আসলে আদালত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকে স্বাভাবিকভাবে আর গুরুত্ব দেন না।’

‘এদিকে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগ বলছে, শ্বাসরোধে মারা যাওয়ার আগে দিয়াজ কোমায় চলে গেছে। কারও মস্তিষ্ক অচল হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তকে আমরা বলি, সে কোমায় চলে গেছে। এখন প্রশ্ন আসে, কোমাতে গেল কেন? ঢামেক বলছে, হাতে, পায়ে, কাঁধে চারটি আঘাতের কারণে দিয়াজ কোমায় গেছে। এখন কথা হচ্ছে কোমায় যাওয়ার জন্য বা মস্তিষ্ক অচল হওয়ার জন্য ওই চারটি আঘাত যথেষ্ট নয়। কারণ কোমায় যাওয়ার জন্য মাথায় কোন আঘাত হয়নি। ঢামেক ও চমেকের প্রতিবেদনে মাথায় আঘাত পাওয়ার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।’

এদিকে ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের একজন প্রভাষকের কাছেও এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। দুটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সুরতহাল ও দিয়াজের লাশের বেশকিছু ছবি বিশ্লেষণ করে তিনি মতামত জানান।

এই ফরেনসিক চিকিৎসক বলেন, ‘ব্রেইন, হার্ট, ফুসফুস বন্ধ হয়ে গেলে তাকে আমরা মৃত বলে ঘোষণা করি। অন্য কোন অর্গান ফেইল করলে আমরা মৃত বলি না। কিডনি, লিভার ফেল হলেও মানুষ মরে যায়। কিন্তু ওই তিনটি- ব্রেইন, হার্ট ও ফুসফুস স্থায়ীভাবে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা মৃত বলি না। ব্রেইন ডেথ হওয়ার আগ মুহূুর্তকে বলে কোমা। অর্থাৎ ব্রেইন কোন কারণে ইনজুরি হয়েছে। মৃত্যুর আগের মুহূুর্তকে বলে মুড অব ডেথ। কোন মুডে মারা যাচ্ছে তা অবশ্যই দেখার বিষয়। ফুসফুস যদি ফেইল করে তবে হবে অ্যাসফাইক্সিয়া। নিউমোনিয়া হয়ে কেউ মারা গেলে তার মৃত্যুকে বলা হবে, সে অ্যাসফাইক্সিয়া হয়ে মারা গেল। কারণ তার শ্বাসকষ্ট হয়েছে। হার্ট যদি ফেইল হয় এবং হার্ট ফেইলে মৃত্যুর আগ মুহূর্তকে বলি সিনকপ।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের ভাষ্য হল, শ্বাসকষ্ট অবস্থায় ঝুলে দিয়াজের মৃত্যু হয়েছে, এর আগে সে কোমায় গেছে। এখন প্রশ্ন কোমা কেন হল? ঢামেক বলছে, ইনজুরির কারণে। একবার বলেছে তার মৃত্যু হয়েছে ফুসফুস বন্ধ হওয়ার কারণে। এরপর বললো ফুসফুস ফেলের আগে তার ব্রেইন ফেইল করলো। কেন ব্রেইন ফেইল করে কোমায় গেল? ঢামেকের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে- বাম হাতে, বাম কাঁধে এবং ডান পায়ে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এখন কথা হচ্ছে, এই আঘাত নিয়ে তার কোমাতে চলে যাওয়ার কোন কারণ নেই। তার ইনজুরি তো কবজির উপরে, কাঁধের বাম পাশে, ডান হাঁটুর নিচে, বাম পায়ের থোরে। মাথায় তো কোন ইনজুরি নেই। আর কোমা ও অ্যাসফাইক্সিয়া- দুটো বিষয় ঢামেকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অবশ্য মৃত্যুর কারণ দুটি হতে পারে, সেক্ষেত্রে কিউমেলেটিভ ইফেক্ট হবে। মৃত্যুর দুটি কারণ হলে ব্যাখ্যাতে নেই কেন? বন্ধ রুমে দরজা ভেঙে মৃত দেহ বের করে আনলে, মৃতদেহে স্যালাইভার উপস্থিতি এসব সুইসাইডের দিকেই যায়। তাছাড়া পার্শিয়াল হ্যাংগিং সাধারণত সুইসাইডালই হয় বলে ধরে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ২য় ময়নাতদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকল।’

চট্টগ্রামের একজন সার্জারি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘গলা টিপে শ্বাসরোধ করে কাউকে হত্যা করা হলে, তার গলায় হাড় ভাঙা থাকবে; যেটাতে আমরা বলি ‘হাই ওয়াইট বোন’। এখন দিয়াজের ক্ষেত্রে এটি ভেঙে যায়নি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী তার শরীরে কোন হাড় ভাঙা নেই, শরীরের ভেতরে আঘাত ও রক্তক্ষরণের কোন আলামত নেই।’

এ প্রসঙ্গে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা তার (দিয়াজ) হাতে, পায়ে ও অন্ডকোষে আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি। অন্ডকোষ সংবেদনশীল অঙ্গ হওয়ায় সেখানে আঘাতের ফলেও কোমায় যেতে পারে।’

তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্ডকোষে আঘাতের কারণে কোমায় যাওয়ার কথা নয়। এছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অন্ডকোষে আঘাতের বিষয় উল্লেখ নেই।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘দুই বার ময়নাতদন্তের পর প্রতিবেদন দুই রকম হয়ে থাকলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি আছে, সেখানে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা দ্বারস্থ হতে পারেন। উচ্চপর্যায়ের এ কমিটি দুটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন রিভিউ করে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে।’

পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থার (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করেই আমরা ব্যবস্থা নিবো। এছাড়া তদন্তের যত প্রক্রিয়া আছে সে সকল প্রক্রিয়া আমরা অনুসরণ করবো। এবং আদালতের নির্দেশনার আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কাজ করে যাবো।’

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে আসছে। লাশ উদ্ধারের পর প্রাথমিক তদন্তে হত্যার আলামত পেয়ে সাধারণত হত্যা মামলা রেকর্ড করে থাকে পুলিশ। এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনায় ঢামেকের ময়নাতদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত। নিহতের স্বজনরা এরকম বেশকিছু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলে আসছেন, হত্যা মামলাটি যারা ‘আত্মহত্যা’র মামলায় রূপান্তর করেছে সেই ময়নাতদন্তকারীর ওপর তাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।

২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর রাতে গুলশান থেকে অভিনেত্রী নায়ার সুলতানার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর শ্বশুর বাড়িতে চিকিৎসক শামারুখ মাহজাবিনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ঢাকার মিরপুরের সাইক ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষার্থী আফসানাকে মৃত অবস্থায় ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট রাতে আল হেলাল হাসপাতালে ফেলে যায় দুই তরুণ। ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় ইডেন কলেজের ছাত্রী সালমা আক্তার শান্তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উপরোক্ত চারটি ঘটনায় আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দিয়েছে ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগ। তবে এসব ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখান করেছিল নিহতের স্বজনরা।